বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: দর্শক হিসেবে আমরাই অভিযোগ করি, বাংলা ছবিতে নতুন কিছু দেখতে পাই না কেন! বেশির ভাগ ছবিই একঘেয়ে লাগে কেন! কিন্তু যখন তেমন কোনও কাজ হয়, এই দর্শক সেভাবে হলমুখী হয় না, কিংবা সেই ছবি প্রেক্ষাগৃহে এমন সব টাইমিং পায় যে সাধারণ দর্শক অনেক সময় চাইলেও গিয়ে উঠতে পারেন না, ফলে সেইসব লাইন থেকে বিচ্যুত ছবির ব্যবসাও মার খায়। শমীক রায়চৌধুরি পরিচালিত ছবি 'বেলাইন'-এর ভবিষ্যৎ তেমন হতে চলেছে কি না জানি না। তবে বাংলা ছবির দর্শক ইদানীংকালের মধ্যে এমন কিছু পর্দায় দেখেননি, হলফ করে বলা যায়।
পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেয়া ভট্টাচার্য এবং তথাগত মুখোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবি মূলত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এই জনার-এ বাংলায় খুব বেশি কাজ হয় না। আর হলেও সেই ছবির মেকিং অনেক সময়ই আশানুরূপ হয় না। বিদেশি ছবির ক্ষেত্রে এই জনার অনেক বেশি সফল। কিন্তু 'বেলাইন' দেখলে, দর্শক ভাববে- আচ্ছা তবে বাংলাতেও সম্ভব।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। এক বৃদ্ধ, যার পৃথিবী বলতে তার ঘরখানা, একটা টিভি আর টেলিফোন। টিভিতে সিরিয়াল দেখা তার অবসরের রসদ। আর রসদ হল ক্রস কানেকশন। প্রায় দৈববলে এক দম্পতির বাড়ির ল্যান্ডলাইন-এর সঙ্গে সংযোগ ঘটে। ফোনে আড়ি পেতে তাদের সমস্ত কিছু শুনতে থাকে। এই যুগলের ঝগড়া, ছেলেটির ক্রমাগত শারীরিক, মানসিক অত্যাচার মেয়েটির প্রতি। তাদের মিলনের শব্দ। সবটাই। একটু আগে টিভিতেও যেন এমনই এক দম্পতিকে দেখেছিল সে। সন্দেহপ্রবণ স্বামী, তার স্ত্রী সতীর ওপর মানসিক নির্যাতন চালায়। এই জনপ্রিয় সিরিয়ালের নামও 'সতী'। 'সতী' এখানে বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। আজকের আধুনিক যুগের সতীরা ঠিক কেমন হয়!
কোন হিংসার শিকার হয় আমরা জেনেও না জানার ভান করি। আজকের যুগে সতীদাহের চিতা মেটামরফসিস হয়ে ইনভিজিবল হয়ে গেছে। সবসময় চোখে দেখা যায় না। কারণ মেন্টাল বা ফিজিকাল অ্যাবিউজ নানা আড়াল ও অ্যালিবাই নিয়ে আসে। কখনও তা ওভার প্রোটেকটিভ স্বামীর শৃঙ্খল, কখনও অত্যধিক প্যাশনের নামে বৈবাহিক ধর্ষণ ছাড়াও আরও নানাবিধ ছল-চাতুরি লুকিয়ে থাকে। বাংলা সিরিয়ালের দর্শকের কাছে এত স্পষ্ট করে দেখানো না হলেও বউকে বাজার করতে যেতে না দেওয়া, অমুকের সঙ্গে কথা বললে স্বামীর রেগে যাওয়া, আবার পরক্ষণেই মিষ্টি কথায় মুড়ে দেওয়া- অমনি দর্শকের বাহবা, আহা স্বামী রাগী হতে পারে, কিন্তু বউকে ভালো তো বাসে! এই মেগা সিরিয়াল দেখাও এক ধরনের ভয়ারিজম, আমরা তা টের পাই না। এই সিরিয়াল দেখার পাশাপাশি আমরা দেখি, এই বৃদ্ধের চোখ চকচক করে যখন সে ফোনে সেই যুগলের আদরের শব্দ শোনে। হ্যাঁ, পর্দায় দেখতে অসুবিধা হবে, কারণ এর মধ্যে সত্যি আছে। সিরিয়াল দেখতে অসুবিধে হয় না, কারণ সেই সত্যির ওপর আছে গাঢ় কৃত্রিম প্রলেপ। বাস্তব জীবন সিরিয়ালের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে এটাও যেন বলে দেয় ‘বেলাইন’।
[আরও পড়ুন: ‘নেতাজিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী’, কঙ্গনার মন্তব্যে হাসির রোল, IQ নিয়ে প্রশ্ন বিরোধীদের]
‘বেলাইন’ এমন এক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার যা শুধু সিনেমার পর্দার চরিত্র নয়, দর্শকের মগজকেও উত্ত্যক্ত করে। বিদেশি ছবির কায়দায় অনেক সংকেত ছড়িয়ে রাখে, যাতে ছবির শেষটা বুঝে ফেলা কঠিন নয়। কিন্তু ছবির উদ্দেশ্য এটা নয় যে আপনি ছবির শেষটা বুঝে ফেললেন কি না। ‘বেলাইন’ তাই কেবল সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার নয়, এই ছবি সেখান থেকেও বিচ্যুত হয়। ব্যক্তিগতভাবে ‘বেলাইন’ আমার কাছে আসলে সোশ্যাল স্যাটায়ার। আর ছবিটা দেখার পর থেকে তাই এতটা অস্বস্তি।
এমন অনেক দৃশ্য আছে যা নানা ভাবনা উসকে দেয়। ঝিরঝিরে হয়ে যাওয়া টিভির মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পায় বৃদ্ধ। তার চারপাশের দেওয়াল ঢেকে যায় টিভির রুপোলি ঝিরঝিরে পর্দায়। দেখতে দেখতে মনে হয়, আমরা সকলেই আসলে এইভাবেই ট্র্যাপড। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় এই ছবির প্রাণ। ছবিতে এমনিতেই সংলাপ কম। শুধুমাত্র এক্সপ্রেশন দিয়ে পরান বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক ছক্কা মেরেছেন। একই ধরনের চরিত্রের বাইরে বেরনোর সুযোগ পেয়ে তিনি সেরাটা দিলেন। একই কথা প্রযোজ্য অভিনেতা শ্রেয়া ভট্টাচার্যের প্রসঙ্গেও। ক্লোজ আপে তিনি তাঁর মুখাবয়বের সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। নিষ্ঠুরতা সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তথাগত মুখোপাধ্যায়। সংলাপ ভৌমিকের এডিটিং এই ছবিকে টানটান রেখেছে। তমালকান্তি হালদারের মিউজিক কখনওই বাড়তি মনে হয় না। সুপ্রিয় দত্তর ক্যামেরা চার দেওয়ালের মধ্যে তৈরি হওয়া এই ছবির মেজাজকে তুলে ধরতে সক্ষম। টিভি সিরিয়ালের দম্পতির সঙ্গে যে লিভ-ইন দম্পতির কনট্রাস্ট– তাদের সম্পর্কের ডায়নামিক্স যেন একটু বেশি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। বিশেষ করে মেয়েটির চরিত্রটি আরও যত্ন নিয়ে লেখা যেত। একেবারে বেচারা অবস্থা থেকে তার যে পরিবর্তন সেটায় কোথাও যেন ঠোক্কর লাগে। তবে এমন প্রয়াস চট করে বড় পর্যায় দেখা যায় না। পরিচালক শমীক রায়চৌধুরির সাহস আছে, স্বীকার করতেই হবে।