সম্প্রতি পেরিয়ে গেল রিজার্ভ ব্যাংক আয়োজিত ‘ফিনানশিয়াল লিটারেসি উইক’। কেনাবেচা হোক বা ব্যাংকিং কিংবা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ- সর্বত্র নিয়মানুবর্তিতা ও সচেতনতা-ই যে ‘Good Financial Behaviour’, সেসব বিষয়েই আলোকপাত এবারের উদ্যাপনে। তবে, রাতারাতি নয়, খুব ছোট বয়স থেকেই অর্থনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা অভ্যাস না করালে, এসব মর্মে ঢুকবে কি? কলমে নীলাঞ্জন দে
সদ্য শেষ হল ‘ফিনানশিয়াল লিটারেসি উইক’, যা রিজার্ভ ব্যাংক সেই ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর পালন করে আসছে। এবারের উদ্যাপনের থিম ছিল খুব স্বচ্ছ এবং পরিচ্ছন্ন- ‘Good Financial Behaviour, Your Saviour’. থিমের অন্তর্নিহিত বার্তাটিও বেশ স্পষ্ট। আপনার ‘ফিনানশিয়াল বিহেভিয়ার’ যদি ঠিক হয়, তাহলে বাঁচোয়া। অতএব নিয়মনীতি মেনে চলুন। এই ‘অতএব’ নিয়েই আমার মনে সংশয়। আসলে তো, এ সেই দেশ, যেখানে আর্থিক কেলেঙ্কারির অন্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ সেই দেশ, যেখানে কয়েক বছর আগেও চিট ফান্ডের রমরমা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সেই দেশ, যেখানে চিনা অ্যাপ ব্যবহার করে লোন নিয়ে সাধারণ মানুষ টাকা হারিয়েছেন। তাই আমাদের আর্থিক অভ্যাস যদি যথাযথ হয়, চেনা-জানা ভুলের পুনরাবৃত্তি না করি, তাহলেই মঙ্গল। নিয়মানুবর্তিতা-ই আমাদের ‘সেভিয়ার’ হতে পারবে, অসাধু ব্যবসার কবল থেকে বাঁচব আমরা। না হলে ব্যাংক নিয়ন্ত্রকের আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন নিছক উদ্যাপনই থেকে যাবে, মানুষের মনে দাগ কাটবে না।
বিশদে বলার আগে কিঞ্চিৎ ভনিতার প্রয়োজন। ভারতে যে ফিনানশিয়াল লিটারেসির প্রবল
অভাব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেক্স এডুকেশনের হিড়িক পড়লেও টাকা-পয়সা সংক্রান্ত শিক্ষাদীক্ষার বিষয়ে আমরা উদাসীন। অথচ দু’টিরই প্রয়োজন আছে। ছোটদের মধ্যে বিশেষ করে- আর বড়দের মধ্যে তো বটেই, স্কুল থেকেই পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। না-হলে পরে হাজার গন্ডগোল লেগেই থাকবে। আবার চিটফান্ড আসবে অন্য কোনও রূপ ধারণ করে, ফের দেখতে পাব ফিনানশিয়াল কোনও ফ্রডের ভিন্ন অবয়ব। ছোট থেকে শেখালে অল্পবয়সিরাও অনেক বিষয়ে সতর্ক থাকবে, চট করে ঠকে যাবে না। সেভিংস, লগ্নি, লোন ইত্যাদির ব্যাপারে এমনই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এই সমস্ত নিয়ে সুশিক্ষা একান্তই জরুরি, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তির অপপ্রয়োগে লোক-ঠকানোর সম্ভাবনা বাড়ছে।
একটু আগে ফ্রড নিয়ে যা বললাম, তার রেশ ধরে জানাই যে, আমাদের দেশে প্রতারণামূলক কার্যকলাপ বাড়ছে। সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ফিনানশিয়াল ফ্রড প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এর এক বড় অংশই হয়েছে অনলাইন মাধ্যম অবলম্বন করে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের আনঅথরাইজ্ড ব্যবহারে, অথবা ই-কমার্স সাইটে। সেই পুরনো ধরনের ফ্রড, যা আগে প্রধানত ক্রেডিট/ ডেবিট কার্ড ব্যবহারকারীরা শোনাতেন, এখনও আছে বটে, তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন অনেক কিছু। এবং প্রায় সবকিছুর মূলে আছে অসতর্কতা অথবা প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞানের অভাব।
[আরও পড়ুন: দীর্ঘকালীন লক্ষ্যপূরণে তুরুপের তাস হতে পারে এই নতুন ফ্লেক্সি ক্যাপ ফান্ড]
আমাদের নিয়ন্ত্রকরা অবশ্য নানারকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ‘সেবি’, ‘আরবিআই’ অথবা ‘আইআরডিএ’ (যথাক্রমে এরা স্টক মার্কেট, ব্যাংকিং এবং ইনশিওরেন্স নিয়ন্ত্রণ করে) নিজস্ব পরিসরে কার্যকলাপ চালাচ্ছে। তবে সব পক্ষের উদ্যোগ একসঙ্গে নেওয়ার অভাবও প্রকট। সঠিক তথ্যের সম্প্রচার থেকে শুরু করে বহুস্তরীয় স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে যৌথ প্রয়াস- সবই প্রয়োজন। না হলে ফ্রড কমা তো দূরস্থান, অনিয়ন্ত্রিত সংস্থার দূরভিসন্ধিমূলক আচরণ বেড়েই যাবে। সাইবার ক্রাইমের জমানায় তা আঘাত করবে সাধারণ মানুষকে। দ্রুত ফাঁকা হবে পকেট, সঙ্গে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো, আর্থিক ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস কমে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে ব্রোকার, লোন সংস্থা থেকে ইনশিওরেন্স কোম্পানি, কেউ-ই সন্দেহের উর্ধ্বে থাকবে না।
আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরি। ফিনানশিয়াল লিটারেসি উইকের সর্বশেষ এডিশনের দুই প্রধান পয়েন্ট লক্ষণীয়। এক, নিয়ন্ত্রক চাইছে ডিজিটাল সার্ভিসেসের যথাযথ প্রসার, এমন প্রসার যাতে সুরক্ষিত থাকতে পারে গ্রাহকরা। দুই, সেভিংস সংক্রান্ত পরিকল্পনার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয়টা দিয়েই শুরু করি আগে। জানেন-ই তো ভারতে সেভিংসের হার বেশ উঁচুর দিকে,
এবং ঐতিহাসিকভাবে তা হয়ে আসছে। সাধারণ খেটে-খাওয়া ভারতবাসী সঞ্চয়ে খুব বিশ্বাস করে, বহু প্রজন্ম ধরে তা প্রতিফলিত হয়ে আসছে নানাভাবে। হাউসহোল্ড সেভিংসের ক্ষেত্রেই দেখুন। বড় মাপের সাশ্রয় করে অনেকে, আর বিভিন্ন সাবেকি পদ্ধতিতে সঞ্চয়ের অভাবও হয় না। অবশ্য এখানে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথাই বলছি।
এতদ্সত্ত্বেও সেভিংসে পরিকল্পনার অভাব খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। অল্প বয়সে ঝুঁকি না-নিয়ে দশকের পর দশক ফিক্সড ডিপোজিটে ইনভেস্ট করে বেশ কয়েকটি প্রজন্মের মানুষ ইনফ্লেশনকে হারাতে পারেনি, এমনও দেখেছি আমরা। বাজারি অর্থনীতি থেকে সচেতনভাবে দূরে থেকেছে অনেকেই, ভুলেও সিকিউরিটিজ মার্কেটে বিনিয়োগ করেনি এক শ্রেণির সঞ্চয়ী।
আমি বাজারি অর্থনীতির গুণ গাইছি না, সেখানে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ যে আছে, তা তো আমরা সবাই জানি। আমি বলছি অতি-রক্ষণশীলতার বিষয়ে, যা করতে গিয়ে আমরা দীর্ঘকালীন রিটার্ন পাইনি। আবার ঠিকমতো সুরক্ষাও পাইনি সবসময়, কারণ একাধিক ভুল-ভ্রান্তি করে মূলধন বা ক্যাপিটালেও যে হাত পড়েছে, সেসবও কয়েকটি ক্ষেত্রে বোঝা গিয়েছে।
তারই সঙ্গে আছে এক ধরনের মানুষের লোভ, যার ফল আমরা দেখেছি চিট ফান্ডের দুনিয়ায়। অনিয়ন্ত্রিত স্কিমে লগ্নি করেছে অজস্র মানুষ, অসম্ভব রিটার্নের আশায় ছুটেছে জনতা। টনক যখন নড়েছে, তখন খুব দেরি হয়ে গিয়েছে, টাকা ফেরত আসেনি। অথচ পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিনিয়োগ সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে থেকেছে তাদের অনেকেই।
এবার আসি ডিজিটাল সার্ভিসেসের বিষয়ে। সুরক্ষিত উপায়ে কীভাবে মানুষ পাবে নানা ধরনের প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক পরিষেবা? এই প্রশ্নের উত্তর এত সহজে দেওয়া যাবে না। সংক্ষেপে, প্রযুক্তিকে সুদৃঢ় করতে হবে, নিয়ম-ভাঙার কড়া শাস্তিও প্রয়োজন। গ্রাহকদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে প্রলোভনে পা না-পড়ে। অর্থাৎ আপনার ব্যাংকার যদি বলে থাকেন পাসওয়ার্ড বা ওটিপি কাউকে না দিতে, তা আপনাকে মেনে চলতে হবে। এ-যুগেও যদি সাধারণ কিছু নিয়ম না-মানেন, তাহলে দোষ আপনারই, তার ভাগীদার আর কেউ হবে না। কাজেই অ্যাপ ব্যবহার করে লোনই নিন অথবা ই-কমার্স সাইটে জিনিসপত্র কিনুন, প্রথম থেকেই সাবধান থাকুন।
আগামী দিনে ডিজিটাল সার্ভিসেসের পরিসর তো প্রবলভাবে বাড়বে। এখনই তার ইঙ্গিত পাচ্ছি ঋণের অ্যাপ্লিকেশনের দ্রুত প্রসেসিংয়ে, অথবা চটজলদি ‘ইউপিআই’ ভিত্তিক ট্রানজাকশনে। এই সমস্ত কার্যকলাপে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে একটা গোটা প্রজন্ম, ভবিষ্যতে মোবাইল ব্যবহার করেই এরা সব পরিষেবা নেবে। সহজে পেয়েও যাবে, কারণ ‘ফিনটেক’-এর প্রসার এবং অন্য ইতিবাচক শর্ত পূরণ হওয়ার জন্য বহু সহায়ক সংস্থা ডিজিটাল সার্ভিসেসে এসেছে। নতুন বাজার ধরতে এদের জুড়ি পাবেন না- বিশেষ করে যেখানে আধা-শহুরে এবং গ্রামীণ মার্কেটের সম্ভবনা উজ্জ্বল। সে নতুনই হোক বা পুরনো,
‘গুড ফিনানশিয়াল বিহেভিয়ার’ সংক্রান্ত নীতি মেনে চলতে হবে সব মার্কেটকেই। প্রসঙ্গটা সামান্য এগিয়ে নিয়ে যাই। ফিনানশিয়াল লিটারেসি সবথেকে বেশি দরকার পিছিয়ে যাওয়া মানুষ এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর। এরা-ই বছরের পর বছর শিকার হয় অসাধু কার্যকলাপের। ইনশিওরেন্স বা ফান্ডের মিসসেলিং (mis-selling) নিয়ে শহুরে গ্রাহক চিন্তিত, কারণ, তাদের ক্ষেত্রেই হয়তো বেশি ঘটে এমনটা। কিন্তু গ্রামীণ গোষ্ঠী যে কম ভোগে না, তা-ও বেশ পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। অল্প-স্বল্প বুঝিয়ে বিমা বিক্রি প্রান্তিক বর্গকে কম করা হয় না। হতে পারে সেখানে টাকার অঙ্ক কম, কিন্তু পিছিয়ে থাকা গ্রাহকের জন্য তা উপেক্ষা করার মতো নয়।
বস্তুত, নিজেকে মিসসেলিং থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব প্রতিটি শ্রেণির মানুষেরই। তাই যদি কোনও বিমা সংস্থার এগ্জিকিউটিভ ওজনদার প্রিমিয়ামের প্রোডাক্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন, তাহলে আপনিও আনন্দে গা ভাসানোর আগে দু’বার ভাবুন। এই প্রোডাক্ট আপনার জন্য কি যথার্থ? একই বক্তব্য রাখা যেতে পারে অন্য নানা ফিনানশিয়াল প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে। নিজের রিস্ক নেওয়ার ক্ষমতা যাচাই না করে ইনভেস্ট করবেন না- এই কথা বারেবারেই বলে দেওয়া দরকার। বলা যে একেবারে হয় না, তা নয়, তবে দেখা গিয়েছে বাজার একটু ভাল হলেই, গতি বাড়লেই, বিনিয়োগকারীরা লালায়িত হয়ে পড়ে। আজ যা বাড়ছে, বা দ্রুতগতিতে ঘুরছে, তা আগামী কাল না-ও হতে পারে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, প্রত্যেকবার হু হু করে বাড়বৃদ্ধি হওয়ার পর ‘বুলিশ’ (bullish) সেন্টিমেন্ট স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। অতি-উৎসাহীর দল আটকে পড়েছে, ভ্যালুয়েশন হঠাৎ কমে যাওয়ার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লগ্নিকারী।
একটু আগে ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্টের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। ভাল গ্রাহক যেন অতি অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়। না হলে তার হাতে চলে আসবে এমন সব সেভিংস প্রকল্প, যা তার আদপে লাগবে না। অনর্থক প্রিমিয়াম গুনতে হতে পারে, বা ব্রোকারেজ দিয়ে যেতে হতে পারে, বা নানা ধরনের চার্জেস সামলাতে হতে পারে। নিজের পরিস্থিতি এবং সব ধরনের জরুরি শর্ত যদি বদলায়, তাহলে লগ্নির ধরনও কেন বদলাবে না? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াও এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয়, সব বিনিয়োগকারী এই প্রসঙ্গে উদাসীন থাকে, যা করণীয় তা করে না। কু-অভ্যাসই বলুন বা নিষ্ঠার অভাব, দিনের শেষে ক্ষতি িকন্তু গ্রাহকেরই।
[আরও পড়ুন: ঋণ দিয়ে লগ্নি? বিকল্প আয়ের দিশা দেখাচ্ছে P2P লেন্ডিং, জানুন খুঁটিনাটি]
এই লেখা শেষ করি সম্প্রতি হাতে পাওয়া ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ফিনানশিয়াল এডুকেশন’ নামক প্রকল্পের কথা বলে। ক্যাপিটাল মার্কেট নিয়ন্ত্রক সেবি-র এই প্রোজেক্ট যদি বিশদে পড়েন, তাহলে চোখ খুলবে- এ-কথা জোর গলায় বলতে পারি। বড় মাপের পরিকাঠামো (সদিচ্ছার কথা বললাম না) ছাড়া অবশ্য পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে না। ভারতের মতো বিশাল দেশের পক্ষে রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয়, তবে প্রকল্পটি খুব ইতিবাচক ভূমিকায় থাকবে। উল্লেখ্য, ফিনানশিয়াল লিটারেসিকে মান্যতা দিয়ে স্কুল সিলেবাসের অঙ্গ করার প্রচেষ্টাও চলছে। ইংরেজি ছাড়াও ভারতীয় ভাষায় অল্প-বয়সিদের পঠনপাঠনের কাছাকাছি পৌঁছনোর কথা বলা হচ্ছে এই প্রসঙ্গে। ভবিষ্যতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সঞ্চয় ইত্যাদি নিয়ে সুশিক্ষা পাবে, এর চেয়ে আনন্দের কথা এই মুহূর্তে আর কী হতে পারে? ছোটদের তো অনেক কিছু দেওয়ার আছে, আধুনিক পাঠ্যক্রম আরও একটু যুগোপযোগী হয়ে উঠুক না, তবেই দায়িত্বশীল নাগরিক গড়তে সক্ষম হব আমরা।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিনিয়োহ উপদেষ্টা
nildey@yahoo.com