সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো, বর্ধমান: কোথাও বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। মাত্রা ছাড়াল শব্দদানব। কোথাও সচেতন নাগরিকের প্রয়াসে জব্দ শব্দ দানব। তবে আতশবাজির দাপটে বিপন্ন বহু অবলা জীব। কেউ জখম হয়েছে। হাউই, ফানুসের আগুনে ঘর পুড়েছে বহু পাখির। জখম হয়ে অনেক পাখি। মৃত্যুও ঘটেছে। সারমেয়দেরও বিপদে ফেলেছে বাজি।
পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমানের একাংশে শব্দবাজির তাণ্ডব গতবারের তুলনায় অনেক কম ছিল। বর্ধমান, কাটোয়া, কালনা, দুর্গাপুরে শব্দবাজির রাশ টানা গিয়েছে এবার। তবে খনি-শিল্পাঞ্চলের জেলা সদর আসানসোল ও সংলগ্ন এলাকায় কালী পুজোর রাতে মাত্রা ছাড়াল শব্দবাজির আওয়াজ। বাতাসে দূষণও ছড়াল নিষিদ্ধ আতশবাজি থেকেও। শব্দবাজির তাণ্ডব সবচেয়ে প্রকট হয়েছিল আসানসোলে। মূলত বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমানার রূপনারায়ণপুর, বরাকরে শব্দবাজির তাণ্ডব চলেছে। এছাড়া আসানসোল, রানিগঞ্জ ও জামুড়িয়ায় বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ফেটেছে বাজি। বাজি পোড়ানোয় বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে শিল্পাঞ্চলে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার ভোর ৫টা পর্যন্ত দুর্গাপুর, আসানসোল, রূপনারায়ণপুর, রানিগঞ্জে এয়ার ইন্ডেক্স কোয়ালিটি ছিল অস্বাস্থ্যকর (আনহেলদি) ও অত্যন্ত খারাপ (পুওর কোয়ালিটি ছিল)। ওই সময়ে দুর্গাপুরে এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স ছিল ৩০৫, রূপনারায়ণপুর ২০০, আসানসোলে ২৬৬, রানিগঞ্জে ১৬৬। তবে শুক্রবার বিকেলের দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। অন্যদিকে, বাতাসে অতি ক্ষুদ্র ধূলিকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী থাকার কথা পিএম ২.৫। বৃহস্পতিবার দেখা গিয়েছে, দুর্গাপুর ও আসানসোলে তার থেকে বহু গুণ বেশি ধূলিকণা। রূপনারায়ণপুর ও রানিগঞ্জে তা চারগুণ বেশি।
পুলিশের অনুমান, ঝাড়খণ্ডের মিহিজাম, কুমারডুবির চিরকুন্ডা থেকে আনা হয়েছিল শব্দবাজি। আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশের ডিসি হেডকোয়ার্টার অরবিন্দ কুমার আনন্দ জানান, "নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি বন্ধ করতে পুলিশের কুইক রেসপন্স টিমের পাশাপাশি, সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা মোটরবাইক, গাড়ি ও রাস্তায় টহলদারি চালায়। সচেতনামূলক প্রচারও চলে।" রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোলের অধিকর্তা সুদীপ ভট্টাচার্য বলেন, "নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়েছে।পুলিশকেও জানানো হয়েছে।" এদিকে, দীপাবলির সন্ধে থেকে শব্দবাজির তাণ্ডব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরে। অনেকটাই আলোর বাজিতে কেটেছে এবারের দীপাবলি। কিন্তু আতশবাজি আকাশে ওড়ার পর যে শব্দবাজিতে রূপান্তরিত হয়ে ফেটেছে তা কিন্তু পিলে চমকানোর মতোই। এই রকম আলোর বাজি যদিও এবার তুলনায় অনেক কম ছিল। কিন্তু তাতেও পথ সারমেয়দের আতঙ্কিত করেছে। ভয়ে ছুটোছুটি করেছে রাস্তায়। তবে নিখাদ শব্দবাজি এবার কম ছিল। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের দুর্গাপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে খোলা হয়েছিলো বিশেষ কন্ট্রোল রুম। শব্দবাজির অভিযোগ আসেনি। পর্ষদের দুটি দল বাঁকুড়া, দুর্গাপুর ও তার আশপাশ নজরদারি চালায়। সেখানেও তাঁরা শব্দ তাণ্ডব খুঁজে পাননি বলে জানিয়েছেন পর্ষদের মুখ্য বাস্তুকার অরূপ দে। তিনি বলেন, "কিছুটা হলেও মানুষের মধ্যে শব্দবাজির বিরুদ্ধে সচেতনতা এসেছে। এটা ভালো লক্ষ্মণ।"
বর্ধমানেও এবার শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে বাজির তাণ্ডব ছিল। যা অবলাদের বিপদের কারণ হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বর্ধমান শহরের মধ্যে তিনটি পথ কুকুর ও দুটি পায়রা অসুস্থ হওয়ার খবর মিলেছে। এর মধ্যে, একটি পায়রার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বর্ধমানের পশুপ্রেমী সংগঠনের সদস্য অর্ণব দাস জানান, শুক্রবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে কুকুর ও পাখি মিলে পাঁচটি প্রাণীর অসুস্থ হওয়ার খবর মিলেছে। এদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটি পাখিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মূলত, অতিরিক্ত শব্দের কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এই সমস্ত প্রাণীরা। হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যু ঘটে। পায়রাটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। শুধুমাত্র শব্দবাজি নয়। এখন ফানুস ও রকেট বা হাউইয়ের ব্যবহার বেড়েছে। এই ফানুস বা রকেট অনেক সময় উঁচু গাছের ডালে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। যার ফলে পাখির বাসায় আগুন ধরে যায় অনেক ক্ষেত্রে। পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পশুপ্রেমী সংস্থা গুলি।
অনেকাংশে শব্দহীন কালীপুজো উপভোগ করলেন কাটোয়া ও গুসকরা শহরবাসী। এমনকি কালীপুজোর অমাবস্যার রাতে অনেক জায়গাতেই শব্দহীন আতশবাজি আগে যা দেখা যেত, এবছর সেটাও অনেক কম ছিল। তবে কালনা, মন্তেশ্বর, পূর্বস্থলীর কিছু জায়গায় শব্দবাজির দাপট ছিল এবার। পূল্ব বর্ধমানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, "নিষিদ্ধ শব্দবাজি ব্যবহার বন্ধ করার জন্য পুজোর আগে থেকেই জেলা পুলিশ অভিযান চালিয়েছে বিভিন্ন বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এছাড়া, পরিবেশ বান্ধব শব্দবাজি ও বিক্রির জন্য বর্ধমানের গোদা এলাকায় বাজি মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। শহর এলাকায় দোকানগুলিতে যাতে নিষিদ্ধ শব্দবাজি বিক্রি করা না হয় সেই দিকে নজরদারি চালিয়েছে পুলিশ। ফলে, বর্ধমান শহর ও সংলগ্ন এলাকায় নিষিদ্ধ বাজির ব্যবহার দেখা যায়নি।"