বিশ্বে ভারতের অবস্থানকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, দেশকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গত দু’-দশক ধরে অর্থনৈতিক সাফল্যের যে সুফলগুলি আমরা ভোগ করে চলেছি তার বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তিনিই। ভারতাত্মা তাঁর মধ্যে এমন এক যুগপুরুষকে খুঁজে পেয়েছিল- যাঁর মধ্যে ছিল মন, হৃদয় ও শক্তির অনন্য সমাহার। নরেন্দ্র মোদি
দেশ যখন নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি এবং অস্থিরতার সম্মুখীন ছিল, তখন দেশে এমন একজন নেতার আবির্ভাবের সৌভাগ্য ঘটেছিল, যিনি জাতির নৈতিক গতিপথ স্থির করে দেওয়ার পাশাপাশি এগিয়ে চলার মতো শক্তিও জোগাতে পেরেছিলেন। দেশবাসীকে তিনি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শিখিয়েছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আরও এগিয়ে যাওয়ার। শতাব্দীর সেই সন্ধিক্ষণের মুহূর্তে ভারত অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে এমন এক যুগপুরুষকে খুঁজে পেয়েছিল, যাঁর মধ্যে ছিল মন, হৃদয় ও শক্তির মতো গুণাবলির এক অনন্য সমাহার। আমরা যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানতাম, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন প্রথম বিরলতম মানুষদেরই একজন, যিনি তাঁর প্রথম সাক্ষাতেই প্রত্যেকের হৃদয়কে স্পর্শ করে যেতেন তাঁর অনুপ্রেরণা দিয়ে। হৃদয়ের গভীর অন্তঃস্তল থেকেই তিনি ছিলেন এক সহমর্মী পুরুষ– যাঁর মধ্যে ছিল শক্তির উদারতা, অপরিমেয় উষ্ণতা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষেত্রে গভীর অনুকম্পা। অন্যদের সম্পর্কে তিনি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। হাস্যরস ও পরিহাসপ্রিয়তার এক বিরল সমাহার ছিল তাঁর মধ্যে। এমনকী, নিজেকে নিয়েও তিনি হাস্য-পরিহাস করতে কখনও দ্বিধা করতেন না। ‘বাগ্মী’ হিসাবে তিনি ছিলেন অনন্য ও অতুলনীয়। একটি সাধারণ হাস্যরসের ঘটনা কিংবা পরিহাসপ্রিয়তাকে অনায়াসে তিনি মুহূর্তের মধে্য রূপান্তরিত করতে পারতেন এক বিশেষ চিন্তাভাবনায়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই সংযোগ ও যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল এক বিরল দক্ষতা। তাঁদের মধ্যে তিনি গড়ে তুলতে পারতেন আত্মবিশ্বাস। বৃহত্তর স্বার্থের কথা তিনি তাঁদের বুঝিয়ে বলতে পারতেন। যে কোনও জিনিসই দ্রুততার সঙ্গে তিনি বুঝে নিতে পারতেন এক অনায়াস দক্ষতায়। জটিলতম যে কোনও বিষয় বা আলোচনাকে তিনি একটিমাত্র বাক্যে অথবা প্রশ্নবিন্যাসে তুলে ধরতে পারতেন।
[‘তিনি বলেই পেরেছেন ৩১টি দলের জোট সরকার চালাতে’]
মধ্যপ্রদেশের উচ্চাদর্শ-সম্পন্ন এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁর যৌবন অতিবাহিত হয়েছিল শিক্ষাগত উৎকর্ষ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক-মুহূর্তে জনসেবার অন্বেষণে। জনসংঘের একজন সাধারণ কর্মকর্তা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে তিনি সংগঠিত করেছিলেন ভারতের একমাত্র ‘প্রকৃত’ জাতীয় দল বিজেপিকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়ের জীবনাবসানের পর তিনি দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সংসদে চার দশকের নেতৃত্বকাল, ‘জরুরি অবস্থা’-র বিরুদ্ধে সংগ্রাম (দিল্লির রামলীলা ময়দানে তাঁর সেই ভাষণ জনতাকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল) এবং আবেগের সঙ্গে দলকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তির এক ‘নতুন সংজ্ঞা’ স্থির করে দিয়েছিল। জাতির স্বার্থেই তিনি তাঁর বক্তব্যকে সর্বদা উপস্থাপিত করতেন। তিনি ছিলেন এক দৃঢ় রাজনৈতিক বিশ্বাসে বলীয়ান। কিন্তু অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো এবং প্রয়োজনে তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও তিনি কোনওরকম দ্বিধা করতেন না। সংসদে বিতর্ক ও আলোচনার মান তিনি স্থির করে দিয়েছিলেন। তাঁর সারল্য ও সংহতি, মর্যাদা ও সহমর্মিতা এবং পদমর্যাদার বাইরেও অতিসাধারণ মানুষের মতো তাঁর জীবনযাপন দেশের যুবসমাজের কাছে এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
[প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, শোকস্তব্ধ দেশ]
নয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে এক বিপর্যয় থেকে দেশের অর্থনীতিকে তিনি পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ওই সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং এক অনিশ্চিত বিশ্ব পরিস্থিতি দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে বিপথগামী করে তুলতে পারত। গত দু’-দশক ধরে অর্থনৈতিক সাফল্যের যে সুফলগুলি আমরা ভোগ করে চলেছি তার বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির অর্থ ছিল দরিদ্রতম শ্রেণির ক্ষমতায়ন এবং প্রান্তিক মানুষদের সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে সংযুক্তি। তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা আজও সরকারি নীতিগুলিকে পথ দেখিয়ে চলেছে।
একুশ শতকে বিশ্বকে নেতৃত্বদানের জন্য যে ভারত আজ সর্বতোভাবে প্রস্তুত তার ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছেন অটলজি। ভবিষ্যতের লক্ষ্যে তাঁর সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার প্রচেষ্টা ভারতীয় সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করেছে। সড়ক ও দূরসঞ্চারের মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপযোগী পরিকাঠামোগুলির উপর তাঁর গুরুত্বদান দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নকে আরও অবদান-সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
অটলজি বিশ্বে ভারতের অবস্থানকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন যে, দেশকে আর কোনও দিন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে জাতির যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে দূর করার পাশাপাশি বিশ্বের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এবং ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি অস্বীকার করার মতো সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন। তা ছিল এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা তিনি খুব সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল খুবই তাৎপর্যময়। ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই আর নেই। জাতীয় গর্বের প্রশ্নে, তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সংযম ও দায়িত্বশীলতার কথা। পৃথিবী এক শান্তিকামী ব্যক্তিত্বের কথাকে সম্মান দিয়েছে। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাঁর অসাধারণ ধারণা এবং কূটনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন বাস্তবতাকে বিশ্বপর্যায়ে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে কৌশলগত কার্যক্ষমতা গড়ে তোলা, জোরদার অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে তুলে ধরা, বহুমাতৃক কূটনৈতিক কর্মদক্ষতা এবং বিদেশে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের শক্তিকে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়েই আমরা সারা বিশ্বে বর্তমানে যে মর্যাদা অর্জন করেছি, তার ভিত গড়েছিলেন।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাঁচ দশকের বিচ্ছেদকে পাঁচ বছরের মধ্যেই এক শক্তিশালী কৌশলগত সম্পর্কে পরিণত করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙন পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে সে দেশের সঙ্গে ভারতের মৈত্রীকে এক কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গভীর করে তুলেছিলেন। ২০০১ সালে নভেম্বর মাসে তাঁর সঙ্গে আমার রাশিয়া সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল। ওই সময় আমরা গুজরাট এবং আস্ত্রাখানের মধ্যে ভগ্নিপ্রতিম প্রদেশ-এর চুক্তি সম্পাদন করেছিলাম। চিনের সঙ্গে শান্তির ক্ষেত্রে, অতীত দিনের সমস্যার বোঝাকে অতিক্রম করার লক্ষ্যে তিনি সীমান্ত-সংক্রান্ত আলোচনার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মতো অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। অটলজির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই দুই প্রাচীন সভ্যতা, যারা বিশ্বের উদীয়মান শক্তি হিসাবে উঠে আসছে, তারা একযোগে কাজ করে বিশ্বের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারে। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি আমার চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে এখনও দিশানির্দেশ দেখায়। তৃণমূল স্তরের ব্যক্তিত্ব হিসাবে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিকে তিনি অগ্রাধিকার দিতেন। নানাভাবে তিনি আমাদের প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দানের নীতির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন, এমনকী এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রদূতের। বাংলাদেশের মুক্তির লক্ষ্যে, একজন বিরোধী নেতা হিসাবে, তিনি নির্দ্বিধায় সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। শান্তির খোঁজে তিনি লাহোর সফর করেছেন। একনিষ্ঠতার সঙ্গে এবং তাঁর স্বভাবসুলভ আশাবাদ নিয়ে তিনি শান্তির খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন এবং জম্মু-কাশ্মীরে ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কারগিল যুদ্ধে জয়ের জন্য তিনি দৃঢ় প্রত্যয় দেখিয়েছেন এবং যখন আমাদের সংসদের উপর আক্রমণ হয়েছিল, তিনি বিশ্বকে ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্তপারের সন্ত্রাসের উৎস এবং ধরন সকলকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন।
[চলে গেলেন ভারতীয় রাজনীতির পিতামহ, কে পড়াবেন রাজধর্মের পাঠ?]
ব্যক্তিগতভাবে অটলজি ছিলেন একজন আদর্শ, একজন গুরু এবং অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যিনি আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনিই আমাকে গুজরাত এবং জাতীয় পর্যায়ে দায়িত্বভার অর্পণ করেন। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের এক সন্ধ্যায় তিনি আমাকে ডেকে বলেন, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে। আমি যখন তাঁকে বলেছিলাম যে, আমি সর্বদা সংগঠনেই কাজ করেছি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারব। যেভাবে তিনি আমার উপর বিশ্বাস অর্পণ করেছিলেন, তাতে আমি বিনীত বোধ করি। বর্তমানে আমরা এক স্বনির্ভর দেশ। আমাদের যুবকদের শক্তি এবং মানুষের দৃঢ় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ এই দেশ, পরিবর্তনের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। এছাড়া এই পরিবর্তন অর্জনে দৃঢ় আস্থা আমাদের রয়েছে। দেশ বর্তমানে এক পরিচ্ছন্ন এবং সংবেদনশীল প্রশাসন হয়ে ওঠার লক্ষ্যে চেষ্টা চালাচ্ছে। সমস্ত ভারতীয়র জন্য সুযোগ ও অন্তর্ভুক্ত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। আমরা বিশ্বের সকলের সঙ্গে শান্তি ও সমতার ভিত্তিতে যুক্ত হই। আমরা নীতির কথা বলি এবং অন্যান্যদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন জানাই। অটলজি-প্রদর্শিত পথেই আমরা এগিয়ে চলেছি। তিনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কারণ তাঁর মধ্যে এক গভীর ইতিহাসচেতনা কাজ করত। আমাদের সভ্যতার মূল্যবোধ বিষয়ে তাঁর দখল থেকে তিনি ভারতাত্মার গভীরে যেতে পারতেন।
একটি জীবনের আলো নিভে গেলে শোকের তীব্রতা থেকেই কেবলমাত্র তার বিচার করা যায় না। মানুষের জীবনে তিনি কী গভীর প্রভাব রেখে যেতে পেরেছেন, সময়ের সঙ্গেই তা বোঝা যাবে। এই কারণেই অটলজি ভারতের প্রকৃত এক রত্ন ছিলেন। তাঁর স্বপ্নের নতুন ভারত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।
The post ‘অটলজি সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন’ appeared first on Sangbad Pratidin.