সৌরভ মাজি, বর্ধমান: সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরেই খুন হতে হয় প্রিয়াঙ্কা হাঁসদাকে। ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ অজয় টুডুকে গ্রেপ্তার করে এমনটাই জানতে পেরেছে পুলিশ। শনিবার ধৃত অজয়কে বর্ধমান আদালতে পেশ করে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। তাকে হেফাজতে নিয়ে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র ও অন্যান্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে চাইছেন তদন্তকারীরা। প্রাথমিকভাবে এই খুনে অজয়ই যুক্ত বলে একপ্রকার নিশ্চিত পুলিশ। তবে আরও কেউ জড়িত কি না তাকে হেফাজতে নিয়ে জানার চেষ্টা করবে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার আমনদীপ সিং বলেন, ‘‘খুনের ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা আততায়ীকে চিহ্নিত করেছিলাম বিভিন্ন সূত্র থেকে। বারবার আস্তানা বদল করায় ধরা যাচ্ছিল না। অবশেষে তাকে ধরতে পেরেছি। দ্রুত চার্জশিট পেশ করে কাস্টডি ট্রায়ালের আবেদন করা হবে। এই মামলায় স্পেশাল পিপি নিয়োগ করা হচ্ছে।’’
গত ১৪ আগস্ট রাতে বর্ধমানের নান্দুর ঝাপানতলা এলাকায় বাড়ির কাছে মাঠ থেকে প্রিয়াঙ্কার রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয়। তার দুই দিন আগে বেঙ্গালুরুতে প্রশিক্ষণ শেষে বাড়ি ফিরেছিলেন প্রিয়াঙ্কা। তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনায় প্রথমে ৯ সদস্যের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট গঠন কলা হয়। পরে সেটি ২১ সদস্যের করা হয়। পুলিশ সুপার জানান, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অজয়ের জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তে উঠে আসে। তার খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়। কিন্তু গত ৯ দিন ধরে বার বার ডেরা বদল করে পুলিশকে ঘোল খাইয়েছে অজয়। শনিবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার হাউর এলাকা থেকে পুলিশ অজয়কে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ফেসবুকের মাধ্যমে বছর চারেক আগে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে পরিচয় হয়। বেঙ্গালুরুতে দুইজনে একইসঙ্গে থাকতো। এমনকি অজয় প্রিয়াঙ্কার বাড়িতেও এসেছিল বলে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। দূইজনে বিয়ে করবে বলেও মনস্থির করেছিল। অজয় পুলিশকে জানিয়েছে, বিয়ে করবে বলে সে প্রিয়াঙ্কার কাছে টাকা জমাচ্ছিল। দুইজনে মিলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা জমিয়েছিল। গত ১২ আগস্ট প্রিয়াঙ্কা ও অজয় বেঙ্গালুরুতে থেকে একই ট্রেনের একই কামরায় চেপে হাওড়ায় এসেছিল। সেখানে মেয়েকে আনতে গিয়ে সুকান্ত হাঁসদা অজয়কে দেখেওছিলেন।
[আরও পড়ুন: হাতে নথিপত্র, ১২ ঘণ্টা তল্লাশি শেষে সন্দীপের বাড়ি থেকে বেরল CBI]
তদন্তকারী অজয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছেন, প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কে সায় ছিল না তার পরিবারের। সেই কারণে সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা অজয়কে এড়িয়ে চলতে চাইছিল। এই নিয়ে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। গত ১৪ আগস্ট অজয় বর্ধমানে আসে। বেশ কয়েকবার প্রিয়াঙ্কাকে ফোন করে। কিন্তু ধরেনি। রাতের দিকে একবার ফোন ধরে প্রিয়াঙ্কা। তাকে দেখা করতে বলে অজয়। প্রিয়াঙ্কা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফাঁকা মাঠে আসে। সেখানে দুইজনের বাগবিতণ্ডা হয়। জমানো টাকা ফেরত চায় অজয়। দুইজনের কথাকাটাকাটি হয়। সেই সময় রাগের মাথায় অজয় ছুরি দিয়ে প্রিয়াঙ্কার গলার নলি কেটে খুন করে। তার পর সেখান থেকে কাছেই গাংপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে হাওড়া চলে যায়। তার পর পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে।
পুলিশ সুপার জানান, অজয়ের খোঁজ পেতে বেঙ্গালুরুতে গিয়েছে দুটি টিম। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরেও যায় টিম। অজয়কে ধরতে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ, জিআরপি দারুণ সহযোগিতা করেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার কাকরাপুঞ্জি গ্রামেও যায় সিট। হদিশ মেলেনি। শুক্রবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশের সাহায্যে পাঁশকুড়ার হাউর থেকে ধরা হয় অজয়কে। মেয়ের খুনি তাদেরই পরিচিত, মানতে চাইছেন না প্রিয়াঙ্কার পরিজনরা। বাবা সুকান্ত হাঁসদা দাবি করেন, অজয়কে আগে কখনও দেখেননি। এমনকি দুইজনের সম্পর্কের কথাও কিছু জানতেন না। তবে হাওড়া স্টেশনে মেয়েকে আনতে গিয়ে ওই যুবককে এক ঝলক দেখেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি এদিন বলেন, ‘‘আমার মেয়েকে শুধু ওই ছেলেটা একা খুন করেনি। ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও কেউ ছিল। একার পক্ষে খুন করা সম্ভব নয় বলেই আমার মনে হয়। বাকিদেরও ধরার দাবি জানিয়েছি।’’ শুক্রবার সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। সেই প্রসঙ্গে এদিন তিনি বলেন, ‘‘আমাকে উকিলবাবু এখন যা বলবেন সেটাই করব। মেয়ের খুনে কেউ ধরা না পড়ায় আমি আদালতে গিয়েছিলাম।’’