নন্দিতা রায়, নয়াদিল্লি: ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত ইস্যু ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ বেসরকারি বিল হিসাবে সংসদে উত্থাপিত হয়ে গেল। শুক্রবার রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ কিরোরিলাল মীনা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা ইউসিসি) বিল, ২০২০ পেশ করেছেন। বিলটিতে প্রস্তাব করা হয়েছে, দেশে ইউসিসি কার্যকর করার জন্য একটি জাতীয় পর্যবেক্ষণ তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। তিনি বিলটি পেশ করার সময়েই তুমুল আপত্তি জানায় বিরোধীরা। তারা এই বিল তুলে নেওয়ার দাবি জানায়। তবে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের হস্তক্ষেপে ধ্বনিভোটে এই বিলের উত্থাপনটি পাস হয়ে যায়। বিলের পক্ষ ৬৩টি, বিপক্ষে ২৩টি ভোট পড়ে। বেসরকারি বিল (প্রাইভেট মেম্বার বিল) হলেও তাতে যে সরকারের সায় রয়েছে, তাও স্পষ্ট।
শুক্রবার দুপুরের পরে সংসদের উভয় কক্ষেই প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাংসদদের হাজিরা খুব কম থাকে। অথচ এদিন রাজ্যসভায় শাসক জোট তথা বিজেপি সাংসদদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা বিলটি পেশের সময়ে হাজির ছিলেন। উল্লেখ্য, অতীতেও এই বিলটি সংসদে উত্থাপনের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চকক্ষে তা উত্থাপন করা হয়নি। রাজনৈতিক মহলের মতে, গুজরাটে মেরুকরণের তাস খেলে বিপুল জনাদেশ পেয়ে জয়ের পর বিজেপি প্রতিশ্রুতি মতো ইউসিসি বিল রাজ্যসভায় পেশ করে ফেলল।
[আরও পড়ুন: আবাস যোজনার কাজে নজরদারিতে আরও কড়া নবান্ন, তৈরি ৯ সদস্যের টাস্ক ফোর্স]
এদিন কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম-সহ বিরোধী শিবিরে থাকা সমস্ত রাজনৈতিক দলই বিলটি পেশের তুমুল বিরোধিতা করে। তৃণমূলের পক্ষে সাংসদ জহর সরকার রাজ্যসভাতেই বিলটিকে ‘সংবিধান বিরোধী’ বলে অভিহিত করে সরব হন। তাঁর অভিযোগ, সরকার ঘুরপথে এই বিল সংসদে এনে সাংঘাতিক খেলা খেলতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে পরে তিনি বলেন, “শাসক শিবির সরকারিভাবে এখনই বিল না এনে যে প্রক্সি গেম খেলছে সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বকলমে দলীয় সাংসদকে দিয়ে বিল পেশ করিয়ে তারা যে জল মাপতে চাইছে তা সবাই বুঝতে পারছে।” বিরোধীরা সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে যে এই ধরনের বিল সামাজিক বন্ধনকে শুধু বিনষ্টই করবে না, ভারতে বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য রয়েছে তাকেও নষ্ট করে দিতে পারে এই বিল।
এদিকে, বিজেপির পক্ষ থেকে পালটা যুক্তি দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহের ৪৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী কেন্দ্র সরকার সারা দেশেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে পারে। এই বিধি কার্যকর হলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে আইনের যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর হবে। উল্লেখ্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ-সহ সমস্ত ধর্মের মানুষ এক পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনের আওতায় পড়বে। আইন এক হওয়ায় শাস্তিও এক হবে। বর্তমানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত পৃথক আইন।
[আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত ভোটের চিন্তায় বুঁদ অনুব্রত, আদালতে বসেও ফিসফিস করে দিলেন ‘দাওয়াই’]
গুজরাট ও হিমাচলের ভোট আবহে মোদি সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অমিত শাহ একাধিকবার সারা দেশে ইউসিসি কার্যকরের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বিজেপি শাসিত তিন রাজ্য–উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাট এই ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়েছে। একটি সাক্ষাৎকারে শাহ স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দেশজুড়ে ইউসিসি কার্যকর মোদি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। ২০২৪-এর মধ্যে তা সম্ভব না হলে ফের ক্ষমতায় ফিরে তা করা হবে। সমস্ত রাজ্যকেও তিনি ইউসিসি কার্যকরে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে ইউসিসি কার্যকর করতে গেলে সংসদে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস কারতে হবে। আর লোকসভায় তা বিজেপির জন্য সহজ হলেও রাজ্যসভায় কঠিন। তাই রাজ্যসভায় বেসরকারি বিল উত্থাপন করে সেখানে হিসাবের অঙ্ক কী দাঁড়ায় তা দেখে নিতে চাইছে কেন্দ্রের শাসক দল।