সন্দীপ্তা ভঞ্জ: শরতের সোনাঝুরি দিনে কাশফুলের বদলে ঘাসফুল উঁকি দেয় যেখানে, সেই প্রবাসের দালানেও ঘরের মেয়ে আসেন হইহই করে। বহিরঙ্গের পার্থক্য আছে বটে, তবুও পুজোর তিলোত্তমা থেকে সাত সমুদ্দুর পারে থেকেও যেন উমার টানেই অনেকটা শিকড়ের কাছাকাছি নিউ জার্সির 'কল্লোল'। মার্কিন মুলুকের এই শহরেও 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাজে আলোকমঞ্জির'। কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের মতোই 'কল্লোল'-এর পুজো প্রাঙ্গণে বসে শারদ মেলা। ম-ম করা চপ-এগরোলের সুবাস থেকে বঙ্গসংস্কৃতির সূচিশিল্প, কারুশিল্প, শাড়ি-গয়না... আহা! যেমন নাম, তেমনই 'কল্লোল'। বিলেতের বুকে যেন একটুকরো বাঙালিয়ানা। এবছরের পুজো প্রস্তুতি কেমন? খোঁজ নিল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
কথাতেই আছে, সময় সব ক্ষততে মলমের প্রলেপ দেয়। নর্থ আমেরিকার 'কল্লোল'-এর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। তিলোত্তমার মন খারাপের ভিড়ে শামিল হয়েছিলেন তাঁরাও। তবে শারদোৎসব দুয়ারে কড়া নাড়তেই ঘরের মেয়ে উমাবরণের প্রস্তুতি তাঁদের তুঙ্গে। প্রায় অর্ধশতাব্দী ছোঁয়ার দোরগোড়ায় নিউ জার্সির কল্লোল-এর দুর্গোৎসব। আটচল্লিশ বছর ধরে আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানা ধরে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে মহাসমারোহে দুর্গোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে এই ক্লাব কমিটি। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে আটের খুদেরা পর্যন্ত এই পুজোয় একসূত্রে গাঁথা এক পরিবারের মতো। শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ভিড়ে শারোদৎসবের প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে 'কল্লোল'-এর সদস্যদের। কলকাতার পুজোর নির্ঘণ্ট থেকে আলাদা হলেও নিয়মে কিন্তু কোনও ফাঁকি নেই। দেবীর বোধন, নবকল্লোল থেকে অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিক্ষণে সন্ধিপুজো, দশমীর সিঁদুরখেলা অক্ষরে অক্ষরে পালন হয় এই পুজোয়।
নিউ জার্সির বুকে ১৯৭৫ সালে শুরু হয়েছিল কল্লোল-এর দুর্গোৎসব। তখন অবশ্য আয়োজনের কলেবর এতটা বড় ছিল না। তবে কালের নিয়মে এখন পরিবার অনেক বড়। নিত্যদিন এক হাজারের বেশি পুণ্যার্থীর ভিড় জমে এখানে। নর্থ আমেরিকার অন্যতম পুরনো দুর্গাপুজো কমিটির এগজিকিউটিভি সদস্য রঞ্জনা সান্যাল জানালেন, "পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি এই পরিবারের গুরুসদস্যদের টান, স্নেহাশীস আর আন্তরিকতাই ৪৮ বছর ধরে এই পুজো ধরে রেখেছে। এটাই আমাদের কল্লোল-এর ইউএসপি। বহুবছর আগে ভবানী মুখোপাধ্যায় এই ক্লাবের পুজো করা শুরু করেছিলেন। বয়স আশি ছুঁলেও এখনও কল্লোল-এর পুজোয় পৌরহিত্য করেন। ডলি চৌধুরী সবথেকে প্রবীণ সদস্য হয়েও আজও পুজোর আয়োজনের পুরোভাগে থাকেন। কলকাতার বারোয়ারি পুজোর মতোই ভিড় হয় এখানে। বিদেশের বেশিরভাগ জায়গায় দুর্গাপুজো যেখানে সপ্তাহান্তে দু'দিন হয়, সেখানে আমাদের ক্লাবে চারদিন ধরেই উদযাপন চলে। এবারও তাই। ১০ অক্টোবর থেকে কল্লোল-এর পুজো শুরু হবে, বিজয়া পালন হবে ১৩ অক্টোবর।"
বিদেশ-বিভুঁইয়ে থেকে যাতে পুজোর আমেজ মিস না করেন বাঙালিরা, সেই জন্য ব্যবস্থাপনাও বেশ জমজমাট। প্রতিমাসজ্জা থেকে শুরু করে মন্ডপসজ্জা, হাতে হাতে সবটা নিজেরাই সারেন। প্রতিবছর পালটায় কল্লোলের পুজোর সাজসজ্জা। যার পুরোভাগে থাকেন আদিত্য প্রতাপ মল্লিক। বছর দুয়েক আগে কুমোরটুলি থেকে আনা প্রতিমা দিয়েই পুজো হচ্ছে এবারও। উমা আগমনের মাসখানেক আগে থেকেই চলতে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া। দুর্গাপুজোর কনসার্ট এখানে বড় চমক। এবার কল্লোল-এর চারদিন ব্যাপী কনসার্টে থাকছেন বাবুল সুপ্রিয়, সুদেষ ভোঁসলে, মধুমন্তী বাগচী, নন্দী সিস্টার্স-এর মতো শিল্পীরা। এছাড়াও অঙ্কন , ধুনিচি নাচ প্রতিযোগিতাও হয়।
বাঙালিরা যেমন আড্ডাবাজ, তেমনই খাদ্যরসিক। পাত পেড়ে ভূরিভোজও হয় কল্লোলে। কলকাতা থেকে দূরে থেকেও কবজি ডুবিয়ে রসাস্বাদনের সুযোগ কী আর হাতছাড়া করা যায়! এবারে কল্লোলের শারদোৎসব স্পেশাল মেন্যুতে কী কী রয়েছে? লম্বা ফিরিস্তি দিলেন কমিটির সদস্য। চারদিনই জম্পেশ সব পদ! ভোগে খিচুড়ি-লাবড়া, বেগুন ভাজার পাশাপাশি বাসন্তী পোলাও, পোস্ত, সরষে বেগুন, মাছের কালিয়া, থেকে চিকেন-মাটন কষার মতো রকমারি বঙ্গরসনা থাকে। রঞ্জনা সান্যাল জানালেন, "কল্লোল-এর পুজো প্রাঙ্গণেই কিন্তু সব রান্না হয়। আর কলকাতা থেকে দূরে থেকেও পুজোর চারদিন বাঙালি খানাপিনার এহেন সাধপূরণের জন্য আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ দুই রাঁধুনী মহাদেব এবং জয়ন্তীর কাছে।"