দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: ভরসা করে মেয়েকে সঁপেছিলেন শিক্ষকের হাতে। মেয়ে মস্ত বড় সাঁতারু হবে। খ্যাতি পাবে। একদিন সবাই জানবে ওর নাম। সেই আশাতেই বুক বেঁধেছিলেন রিষড়ার ওই প্রতিশ্রুতিমান কিশোরী সাঁতারুর পরিবার। মাসখানেক আগেই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন রাজ্যে। যেই কোচকে তাঁরা ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিলেন, সেই সুরজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ই কি না এমন কাজ করলেন? ভাবলে এখনও নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে নির্যাতিতার বাবার। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন ক্রীড়ামন্ত্রী। যথাযথ পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে সুরজিতের বিরুদ্ধে। তবুও সব কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। পালটে গেল চাওয়া-পাওয়ার সংজ্ঞাগুলো। চোখে জল আর ভগ্ন হৃদয়ে নির্যাতিতার বাবা এখন থানা-পুলিশ আর সংবাদ মাধ্যমের মাঝেই ছোটাছুটি করছেন।
[আরও পড়ুন: সোনাজয়ী সাঁতারুকে যৌন হেনস্তা, প্রমাণ-সহ অভিযোগ দায়ের কোচের বিরুদ্ধে ]
রিষড়ার বাসিন্দা ওই কিশোরীর বাবা পেশায় গাড়ি চালক। গাড়ি চালিয়েই সেই অর্থে দিন গুজরান করেন। “মেয়ের প্রতিভা রয়েছে” প্রশিক্ষক সুরজিত গাঙ্গুলির এই কথাটা শুনেই স্বপ্ন দেখা শুরু করে ওই পরিবার। সেই প্রতিভা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য গোয়ায় গিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রয়োজন- ঠিক কথাগুলিতেই মেয়ের সাঁতারু হওয়ার স্বপ্নে বিভোর পরিবার প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই সামান্য অর্থে দরিদ্র বাবা-মায়ের পক্ষে গোয়ার মতো জায়গায় সন্তানের বিপুল ব্যয়ভার চালানো অত্যন্ত কঠিন ছিল। তা স্বত্তেও অর্থ অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। রিষড়ায় কাজ ছেড়ে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে গোয়ায় পাড়ি দেন কিশোরীর বাবা। সেখানে খরচ চালানোর জন্য একটি গাড়ি চালানোর কাজও খুঁজে নেন। এরপর সুরজিতের কাছে নতুন করে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু হয় কিশোরী সাঁতারুর।
প্রসঙ্গত, বালিতে এই কিশোরীর সাঁতার জীবনের প্রথম প্রশিক্ষণের শুরু সুরজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। কিশোরীর প্রিয় ইভেন্ট ‘ব্রেস্ট স্ট্রোকার’। ইতিমধ্যে জাতীয়স্তরে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে স্বর্ণপদক-সহ বেশ কিছু পদকও জিতেছে সে। গোয়ায় যাওয়ার পর সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই গুজরাটের রাজকোটে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি কিশোরী। কারণ সে আর আগের মতো সাঁতারে মন দিতে পারছে না, বেশিরভাগ সময়েই অন্যমনস্ক থাকছে। মেয়ের অন্যমনস্কতায় বিরক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ বাবা মেয়েকে রীতিমতো বকাঝকা করেন। তখনই কান্নায় ভেঙে পড়ে কিশোরী। বাবা মাকে সমস্ত ঘটনার কথা জানায়।
“কাউকে না কাউকে তো প্রতিবাদ করতে হয়। প্রশিক্ষক যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে এই ধরনের অশালীন আচরণ করতে না পারেন”
জাতীয় সাঁতারুর অভিযোগ, গোয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণের নামে শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করে তার উপর যৌন নির্যাতন চালাতেন প্রশিক্ষক। মাঝে মধ্যেই তাদের ভাড়া বাড়িতে চলে আসতেন। ৬ মাস ধরে এইভাবে তার উপর যৌন নির্যাতন চলায় তার মানসিক বিপর্যয় ঘটে। ফলে সাঁতারে ভাল ফল করতে পারে না সে। মুখ খুললেও কেরিয়ার নষ্ট করে দেওয়ার হুমকি দেন তাঁকে। দিনের পর দিন কিশোরীকে ব্ল্যাকমেল করতেন। শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষকের এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসে কিশোরীর পরিবার।
তবে অভিযুক্ত ওই প্রশিক্ষকের কুকীর্তির তালিকা এখানেই শেষ নয়। বাংলার সাঁতার মহলেও নাকি অতীতে এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি! কিন্তু, কোচের কুকীর্তি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি কেউই। পাছে, কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যায়! উপরন্তু কোনও প্রমাণ নেই বলেই প্রকাশ্যে তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে রিষড়ার এই কিশোরী যা করল, তাতে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর ৫টা মেয়ের প্রতিবাদী সুর আরও চড়াও হবে, তা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
[আরও পড়ুন: গোয়ায় দিনের পর দিন যৌন নিগ্রহ, কোচের লালসার শিকার বাংলার সোনাজয়ী সাঁতারু ]
সুরজিতের উপর কলকাতার সাঁতার মহল ভীষণই ক্ষুব্ধ। প্রাক্তন সাঁতারু বুলা চৌধুরীর কথায়, “শিক্ষক তো বাবারই মতো। শিক্ষক হিসেবে সুরজিতের এই ব্যাভিচার মেনে নেওয়া যায় না। আমার সব শুনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।’’
আর কী বলছে ওই জাতীয় সাঁতারু কিশোরী? তাঁর কথায়, কাউকে না কাউকে তো প্রতিবাদ করতে হয়। প্রশিক্ষক যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে এই ধরনের অশালীন আচরণ করতে না পারেন, সেই জন্যই আইনের দ্বারস্থ হয়েছি এবং অভিযুক্তর কঠোর শাস্তি দাবি করেছি।
The post ভরসার এই প্রতিদান দিলেন কোচ! চোখে জল নির্যাতিতা সাঁতারুর বাবার appeared first on Sangbad Pratidin.