সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সাজিয়ে গুছিয়ে শরীরকে নানান রঙে রাঙিয়ে গো-বন্দনা। আর তার পরে সেই গরু বা কাড়া (মহিষ)কেই খুঁটিতে বেঁধে ধামসা, মাদল বাজিয়ে মুখের কাছে চামড়া নিয়ে তাকে ক্ষেপিয়ে তোলা। এ যেন বাংলার বুকে বুল ফাইটিং! এই ভাবেই ছোটনাগপুর মালভূমির পুরুলিয়া-সহ তামাম জঙ্গলমহলে শুরু হয়েছে বাঁদনা বা সহরায় পরব।
কার্তিকের অমাবস্যার রাত থেকে এই উৎসব শুরু হয়। পাঁচদিন ধরে এই পরব চলে। তবে বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন দিনে উৎসব হয়ে থাকে। কবে এই পরব হবে তা ঠিক করেন গ্রামের মানুষজনই। তবে কার্তিকের অমাবস্যায় শুরু হওয়া এই উৎসব একেবারে মকর সংক্রান্তির আগে পর্যন্ত চলে এই বনমহলে। প্রথম দিন গরু, কাড়াকে রাত জাগিয়ে রাখা। যাকে বলা হয় জাগরণ। অর্থাৎ অমাবস্যার রাতে গরু, কাড়ার সিং-এ তেল দিয়ে, নানান রঙে রাঙিয়ে এমনকি দীপ দেখিয়ে ধামসা-মাদল নিয়ে জাগিয়ে রাখা হয়। পরের দিন হয় গড়য়া। অর্থাৎ গোয়াল পুজো। তৃতীয় দিনের বিকাল দিকে গরুকে খুঁটিতে বেঁধে ধামসা, মাদল বাজিয়ে মুখের কাছে চামড়া নিয়ে তাকে রাগিয়ে আনন্দ পান গ্রামের মানুষজন। চতুর্থ দিন বুড়ি বাঁদনা। এদিন নানান জায়গায় মেলা হয়। সেই সঙ্গে কাড়াকে ওই একইভাবে খুঁটিতে বেঁধে রাগানো হয়। পঞ্চম দিনে কাঁটা কাড়া। ওই দিন কোথাও কোথাও বুলবুলি নাচ,যাত্রা, গান-সহ নানান স্থানীয় সাংস্কৃতিক উৎসব হয়।
[আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফের রক্ত ঝরল দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, সহকর্মীকে খুন যুবকের]
পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “বাঁদনা বা সহরায় উদযাপনের মধ্য দিয়ে সমস্ত বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা ভুলে গ্রামের মানুষ গো-পালনে মেতে ওঠেন। এই পরব একদিকে যেমন গো- বন্দনার উৎসব। অন্যদিকে মানুষে মানুষে মেলবন্ধনকে সুদৃঢ় করে। ফলে এই পরব সম্প্রীতির বন্ধন।” এই উৎসবের তৃতীয় দিন মঙ্গলবার আড়শার
বামুনডিহা গ্রামে ওই গ্রামের কমিটির উদ্যোগে ‘গরুখুটা’ উৎসব হয়। এই উৎসবে অংশ নেওয়া গরুর মালিকদের গামছা প্রদান করে ওই গ্রাম কমিটি। গ্রাম কমিটির তরফে দেবীলাল মাহাতো বলেন, “পুরুলিয়ার এই উৎসব যাতে আরও সমৃদ্ধ হয়। প্রচার, প্রসার ঘটে সেই জন্যই আমরা গ্রাম কমিটির তরফে এই উৎসব পালন করে অংশগ্রহণকারীদের গামছা প্রদান করে উৎসাহিত করলাম।”
মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে আরও মজবুত করতেই এই উৎসব। আমন ধান বাড়িতে তোলার আগে গো-বন্দনা করে যেন কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। আসলে এই গবাদি পশুকে ব্যবহার করেই চাষের জমি সবুজ হয়। ফলন ভালো হয়। মা উমা কৈলাসে বিদায় নেওয়ার পর থেকেই অহিরা গানে এই উৎসবের আগমনী। সেই সময় থেকেই নানান দেওয়াল চিত্রে ঘর-দুয়ার সেজে ওঠে। ধামসা-মাদল মেরামত করার কাজ চলে।