রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৮৮৪-র ২১ এপ্রিল আত্মহত্যা করলেন রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠান কাদম্বরী, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে, রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাস পরেই। কাদম্বরীর সঙ্গে গহন সম্পর্কের স্মৃতি ও বেদনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ক্রমশই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বসবাস অসহনীয় হয়ে উঠল। তিনি প্রায় একটানা দশ বছর, তাঁর তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত, জোড়াসাঁকোর বাড়ির পরিসর ও পরিবেশ থেকে, রইলেন পলাতক।
কিন্তু কাদম্বরীর আত্মহননের কাঁটায়-কাঁটায় দশ বছর পরে, ১৮৯৪-এর ২০ এপ্রিল, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে! কেননা তিনি তীব্রভাবে ফিরে পেতে চান তাঁর দশ বছর আগের যাতনা, দহন, ক্লিশিত কান্না। এবং সেই বিপুল ব্যথাতুরতার মধ্যে কাদম্বরীর মৃত্যুদিনেই তিনি লিখলেন এমন এক আখর-যুক্ত অবিকল্প কীর্তন, মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে, যে-রকম উজাড়-করা ‘উজান’ তিনিও বেশি লিখতে পারেননি। এই কীর্তনের ছত্রে-ছত্রে ছড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের একান্ত ব্যক্তিগত মর্মের কথা, অন্তরব্যথা। এবং আছে তাঁর এই স্বীকারোক্তি: এই কণ্টকময় সংসার পথে, তিনি কাঁদবেন না হৃদয়ব্যথায়, তিনি বাকি জীবন নীরবে যাবেন, সব জ্বালা হৃদয়ে ধারণ করে।
তাঁর রবীন্দ্রগান গাওয়ার ৩৫ বছর পূর্ণ হওয়ার এক অতুল অনুষ্ঠানে উত্তম মঞ্চে ১০ নভেম্বর রবিবার সন্ধ্যায় কুড়িটি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করলেন অদিতি গুপ্ত। এবং রবীন্দ্রনাথের সুর ও বাণীতে অনন্য হয়ে ওঠা এই রবীন্দ্রকীর্তনে অদিতি তাঁর দরদ, তাঁর সংবেদ এবং তাঁর নিজস্ব বেদনাবোধের সবটুকু নিংড়ে দিলেন। এমনকী অদিতির পক্ষেও এই কীর্তন দ্বিতীয়বার ঠিক এইভাবে একূল-ওকূল ভাসিয়ে গাওয়া সম্ভব হবে কি? জানি না।
শুধু এইটুকু জানি, অদিতির কণ্ঠের মগ্নতায়, ধ্যানে, সমর্পণে, ব্যাকুলতা এবং সংবেদনায় এই কীর্তন আমাকে ছেড়ে যাবে না বাকি জীবন। অদিতি পেরেছে, সত্যিই পেরেছে, রবীন্দ্রনাথের এই সুর-বাণী-আখর অনন্তে ভাসিয়ে দিতে: ‘অপরাধ যদি করে থাকি পদে, না করো যদি ক্ষমা, / তবে পরাণপ্রিয় দিয়ো হে দিয়ো বেদনা নব নব। দিয়ো বেদনা–যদি ভালো বোঝ দিয়ো বেদনা– বিচারে যদি দোষী হই দিয়ো বেদনা।’
নতুন বউঠানের আত্মহত্যার জন্য তিনি নিজে কতটা দায়ী? এই প্রশ্নও দহিত করছে রবীন্দ্রনাথকে। তিনি জানিয়ে গেলেন সেই বেদন ও অপরাধ বোধ। এই গান আমি বহু কণ্ঠে শুনেছি। কখনও শুনিনি অদিতির বেদনার্ত বৈভবে আনন্তিক হয়ে ওঠা এই কীর্তন!