নন্দিতা রায়, নয়াদিল্লি: শুভ যা কিছু, প্রথম জন তার প্রতীক। আর দ্বিতীয় জন অশুভ-র সমার্থক। অশুভ শক্তিকে হারিয়ে শুভ শক্তির জয়ের অমর গাথা রামায়ণ। অথচ কালের বিবর্তনে এক উত্তরপ্রদেশের মাটিতেই পূজিত উভয়ই। অযোধ্যাভূমে রঘুকুলপতি শ্রীরামচন্দ্র আর গ্রেটার নয়ডার বিশরখে দশানন রাবণ।
উত্তরপ্রদেশের এক প্রান্তে অযোধ্যায় যখন রাম নিয়ে রমরমা তখনই সেখান থেকে সাড়ে ছশো কিলোমিটার দূরে সেই রাজ্যেরই বিশরখ গ্রামে চলছে রাবণ পুজোর। কারণ, রাবণ এখানকার ভূমিপুত্র। গ্রামের নামও রাবণেরই পিতা বিশ্বশ্রবা মুনির নামেই। বিশরখের স্থানীয় মানুষজনের দাবি– রাবণের জন্ম, বেড়ে ওঠা, তপস্যা, সব কিছু এখানেই। পরে তিনি লঙ্কায় গিয়ে সৎভাই কুবেরের থেকে সোনার লঙ্কা দখল করেছিলেন। তবে রাবণ মন্দির নামে পরিচিত হলেও মন্দিরের অন্দরে তাঁর কোনও বিগ্রহ নেই। সেখানে নিত্যপুজো হয় রাবণেরই আরাধ্য শিবলিঙ্গের। মন্দিরে প্রবেশদ্বারের দুপাশ জুড়ে রাবণের মূর্তির সঙ্গে তাঁর বাবা-মা, ভাইবোন পুরো পরিবারের সঙ্গে তাঁরও তপস্যারত মূর্তির অবস্থান। সংলগ্ন পাশের ঘরে রাবণের একটি বিগ্রহ রয়েছে বটে তবে সেই ঘর তালাবন্ধ। প্রধান পুরোহিতের অনুপস্থিতিতে চাবি অমিল। একমাত্র দশমীর দিনেই সেই মূর্তি বাইরে দর্শন ও পুজোর জন্য নিয়ে আসা হয়। চমকপ্রদভাবে, যেহেতু রাবণের গ্রাম তাই গ্রামজুড়ে স্থানীয়দের নামেও রাম-রাবণের ছড়াছড়ি।
[আরও পড়ুন: রামমন্দির উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা রাষ্ট্রপতির, কী জবাব দিলেন মোদি?]
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামদাস, মেজো পুরোহিতের নাম রামচন্দ্র। এছাড়াও গ্রামের বহু মানুষের নামই দশানন। গ্রেটার নয়ডার গলি-ঘুঁজি পার করে এতদিন পর্যন্ত স্থানীয়দের মধ্যে পরিচিত থাকলেও অখ্যাত বিশরখ গ্রাম রাতারাতিই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে রাবণ মন্দিরের দৌলতে। শীতের মিঠে রোদ্দুরে মন্দির চত্বরেই বসে সময় কাটাচ্ছিলেন পুরোহিত রামচন্দ্র। আলাপ করতেই নিজেই মন্দিরের ইতিহাস থেকে সবকিছু বলে গেলেন গড়গড় করে। বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আনাগোনা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাই সব প্রশ্নেই উত্তরে সমান সাবলীল। রামচন্দ্রের কথায়, “এই গ্রাম রাবণের গ্রাম, তাঁর পিতৃপুরুষেরও গ্রাম। বিশ্বশ্রবা মুনি-র নামেই আমাদের গ্রাম। এখানে রাবণ তো বটেই। তাঁর বাকি ভাইবোন, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ, শূর্পনখার জন্ম হয়েছিল। রাবণের বাবা বিশ্বশ্রবা মুনি শিবভক্ত ছিলেন। তিনিও এই মন্দিরেই পুজো করতেন। রাবণও এই শিবলিঙ্গের কাছেই তপস্যা করেছিলেন ও নিজের দশটি মাথা কেটে, অর্পণও করেছিলেন। এখান থেকেই তিনি লঙ্কায় গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে।”
সারা বছর মন্দিরে রাবণের পুজো না হলেও বিজয়া দশমীর দিনে উত্তর ভারত-সহ সারা দেশ যখন রাবণ দহন তখন এখানে চলে রাবণের পুজো। সঙ্গে বিলাপও। সেদিন অন্যান্য জায়গায় যখন সকলে ভূমিপুত্র রাবণের কুশপুত্তলিকা দাহ করার শোক পালন করেন, তখন বিশরখের বাসিন্দারা অশ্রু বিসর্জন করে শোক পালন করেন। মন্দিরের অন্দরে রাবণের মূর্তি না থাকার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রামচন্দ্র। বলেছেন, “রাবণ এই মন্দিরেই শিবের আরাধনা করতেন তাই মন্দিরেও আরাধ্য দেবতা শিবই। ত্রেতা যুগ থেকেই এই মন্দির রয়েছে। মন্দিরের শিবলিঙ্গ সাত হাজার বছর পুরনো। প্রশ্ন, ভক্ত আর ভগবান একসঙ্গে কীভাবে পূজিত হবেন? উত্তর হল, মন্দিরের প্রবেশদ্বারের দেওয়ালে রাবণের মূর্তি রয়েছে আর অযোধ্যায় রামলালার বিগ্রহ বসানোর পর এই মন্দির চত্বরেও রাবণের মূর্তি বসানো হবে। জয়পুরের মূর্তিকার দশাননের পিতলের মূর্তি তৈরি করছেন, দু’ফুটের সেই মূর্তিরও দশটি মাথা থাকবে। এ বছর বিজয়া দশমীর দিনেই মূর্তি স্থাপন করা হবে বলে ঠিক হয়েছে।”
[আরও পড়ুন: রামমন্দিরের তহবিলে অনুদান দিলেই মিলতে পারে করছাড়, জেনে নিন কীভাবে?]
সোমবার অযোধ্যায় রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনেই রাবণ মন্দিরেও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বসবছে রাম দরবার। “রাবণই যেখানে মুখ্য সেখানে রামের পুজো?” প্রশ্ন করতেই মন্দিরের ছোটো পুরোহিত প্রিন্স মিশ্রের দাবি, “রাবণের জন্যই তো রামের জন্ম হয়েছিল। রাবণের জন্যই তো রামের এত পরিচিতি। রামজিও আরাধ্য তবে এখানে রাবণই প্রধান। রামজির সঙ্গে সেদিন রাবণেরও পুজো হচ্ছে।” মন্দিরের বাইরের দেওয়ালজুড়ে রাবণের পরিবারের পাশাপাশিই মন্দিরের অন্দরের দেওয়াল জুড়ে শিব-পার্বতীর ছবি। প্রবেশদ্বারের মাথার উপরে বিরাজমান গণপতি। এই মন্দির অতীতেও চর্চায় উঠে এসেছে বলেও জানালেন মিশ্র। বললেন, “জমি দখল করার জন্য এখানকার শিবলিঙ্গ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল অনেকবারই কিন্তু শিবলিঙ্গের শেষ অংশ মেলেনি। পরে ’৯০ সাল নাগাদ এক সাধু চন্দ্রস্বামীর উদ্যোগে পুরাতত্ত্ব বিভাগের লোকেরা এসে খনন চালান। সেইসময় খননে বিশমুখী শঙ্খ উঠে এসেছিল আর কিছু জিনিসপত্রও। কিন্তু তাঁরাও শিবলিঙ্গের শেষ খুঁজে পাননি। পরে পুরাতত্ত্ব বিভাগ জানিয়েছে, শিবলিঙ্গ সাত হাজার বছর পুরনো। পুরনো মন্দিরের কিছু অবশিষ্ট নেই এখন। নতুন মন্দির অবশ্য বহু বছর আগে হয়েছে। কমপক্ষে বছর চল্লিশ তো হবেই।”
মন্দির চত্বরেই ঘুরে বেড়ানো বছর চোদ্দোর শিব ভাটি, দাদু দশাননের কাছ থেকে গল্প শুনেই বড় হয়েছে। নিজেকে রাবণের বংশধর বলেই দাবি করা শিবের কথায়, “এটা যে রাবণের গ্রাম, তা ছোট থেকেই জানি। এখানেই দশটা মাথা কেটে শিবজিকে দিয়েছিলেন রাবণ। এই গ্রামের সকলেই তো রাবণের বংশধর। আমিও তাই। আমাদের কাছে রাবণ ভগবান। আমরা তাঁর পুজো করি।” মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামদাস, মেজো পুরোহিতের নাম রামচন্দ্র। এছাড়াও গ্রামের বহু মানুষের নামই দশানন।