চারুবাক: ছবির শুরু হয় জয় গোস্বামীর লাইন “বলো কী বলবে আদালত, কিছু বলবে কি এর পরও? যাও, অজীবন অশান্তি ভোগ কর” দিয়ে। আর তখন থেকেই ইঙ্গিত থাকে নিছক প্রেম বা হারানো প্রেমের গল্প হবে না ‘রবিবার’। হয়ওনি। জীবনের জটিলতার এক আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে দু’টি চরিত্র- সায়নী আর অসীমাভ।
তালু থেকে জাস্ট ঝরে পড়া বছরটা যখন গোয়েন্দা, গুপ্তধন আর নিশ্চিত ব্যবসায় গলিখুঁজিতে আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত ছিল। ঠিক তখন অতনু ঘোষ নিয়ে এলেন অন্যতর ভাবনার এক গল্প। গল্পই বা বলি কেন? দু’টি মানুষের সমঝোতা আর স্বার্থের ধারাবাবরণী। ডার্ক চরিত্র নিয়ে বাংলা ছবির পুরো বয়ান এই প্রথম। অথচ অসীমাভ কি সত্যিই কালো চরিত্রের? হ্যাঁ। সে জীবন কাটিয়েছে জালিয়াতি, সুপারি, খুন এবং দু-নম্বরি পথে। সায়নীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদের কারণও সেটাই। কিন্তু অসীমাভর মধ্যে কি একজন সুস্থ মনের প্রেমিকও লুকিয়ে ছিল না? নাহলে সায়নীকে লেখা কয়েক দিস্তা না পাঠানো চিঠি কেন দেখায় সে? যদিও চিঠিগুলোর বয়ান অজানা। শুধু সায়নীকে হারানোর বেদনাই নয়, অনাগত ও অজন্মা সন্তানের জন্যও রয়েছে তার যন্ত্রণা, দুঃখবোধ। সর্বোপরি অসীমাভ প্রায় আচমকাই ১৫ বছর পর সায়নীর দেখা পেয়ে অতীতটাকে বুনতে চাইছিল বারবার- কেন?
[ আরও পড়ুন: মন ভাল করা ছবি, সংলাপেই বাজিমাত ‘গুড নিউজ’-এর ]
এগুলোই বুঝিয়ে দেয় অসীমাভর মধ্যে একটা ধূসর এলাকাও রয়েছে। যেমন রয়েছে সায়নীর জীবনেও। সে এক বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার আইনজ্ঞ হয়েও বেআইনি কাজে মদত দিয়েছে নিজের স্বার্থে। এমনকী জালিয়াত অসীমাভকে তার লেখার রসদ করে ব্যবহারেও পিছপা হয় না সে। একা সায়নীর মধ্যেও চলে দোলাচাল। বাবা-মায়ের সঙ্গ নয়, একাকীত্বই তার সঙ্গী- কেন? অসীমাভকে হারিয়ে কোনও বেদনাবোধও কি তার নেই? কিন্তু সেখানে নিজের কাছেও সে দ্বিধাচিত্ত। এই অসীমাভকেই নিজের স্বার্থে সায়নী ব্যবহার করে। অর্থাৎ তার মনের মধ্যেও ধূসর একটি অংশ আছে। নাহলে অজন্ম সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে সায়নী অসামীভকে বিঁধবে কেন?
ওই যে একবার অসীমাভ বলে না, “অসীমাভকে তৈরি করা যায় না, অসীমাভ জন্মায়।” ঠিক তাই সায়নীও। লম্পট, স্বার্থপর, লোভী, জালিয়াত মানুষের মধ্যেও অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে একজন কবি, মননশীল মানুষ। যে মানুষটি একসময় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। ভাল আর মন্দের এই ছন্দের সংঘাত নিয়েই অতনু ঘোষের ‘রবিবার’। এখনকার বাংলা সিনেমায় এক অনন্য ব্যতিক্রম। তার চিত্রনাট্য অবশ্যই লিনিয়ার নয়। চলতি প্রথায় ফ্ল্যাশব্যাকও নেই। ফলে দর্শকের কাছে একটু কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু as a cinema, ‘রবিবার’ এক অভিজ্ঞতা। হ্যাঁ। অবশ্যই অতনু পারতেন চিত্রনাট্যকে আরও ফ্লুইড করে দর্শকের কাছে পৌঁছতে। কিন্তু ঘটনার পরিমণ্ডল এমনভাবে সাজানো, যেখানে অন্যরকম ফর্ম হয় না। গল্প কখনই সরলরেখায় বলেন না অতনু। কিন্তু সিচুয়েশন তৈরি করে আভাস দেন। ‘রবিবার’-এ সেই আভাসগুলো অনেক বেশি গূঢ় ও গম্ভীর। অথচ সিনেম্যাটিক্যালি দারুন কাব্যময় ও নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
[ আরও পড়ুন: অভিনয়ের আলোতেই ‘সাঁঝবাতি’ জ্বালালেন দেব-সৌমিত্র ]
ছবিটি ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি স্তম্ভের ওপর। এক প্রসেনজিৎ ও জয়ার অসাধারণ অভিনয়; দুই, দেবজ্যোতি মিশ্রর সংগীত কাঠামো; তিন, ছবির চিত্রগ্রহণ। প্রসেনজিৎ নিজেকে কতটা ভাঙতে পারেন, তার প্রমাণ ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ আর ‘রবিবার’। নেগেটিভ বলব না, ধূসর চরিত্র অসীমাভর জন্য নিজেকে তিনি কতটা বদলেছেন, সেটা দেখার জন্যই ‘রবিবার’ একবার দেখতেই হবে। জয়া আহসার তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং আলগা চটক দিয়ে সায়নীকে জীবন্ত করেছেন। একটাই আক্ষেপ, সুপারি লটকাইয়ের চরিত্রটার অত ডিটেলস দেখানোর দরকার ছিল না। যেমন অস্পষ্ট থাকে শিশু চরিত্রটির পরিণতিও। যদিও শ্রীজাত মন্দ করেননি। দেবজ্যোতির আবহ সঙ্গ না দিলে এই ছবির বহু দৃশ্যই পরিচালকের কাঙ্খিত পরিবেশ তৈরি করতে পারত না। রূপঙ্করের গাওয়া ‘কালরাতে মাঝরাতে’ ছবির প্রিল্যুড হিসেবে অসাধারণ।
অতনু ঘোষের এই ‘রবিবার’ সংগীত, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনার (সুজয় দত্ত রায়) সাবলীল ছন্দ মিলিয়ে এক অন্যরকম সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে দর্শকদের। হোক না এই ছবি পার্সোনাল, হোক না বাস্তব বোধ বর্জিত। একজন মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একাধিক মানুষের আঁচ তো পাওয়া গেল!
The post বিষয়ে অভিনব ও অভিনয়ে উৎকৃষ্ট ‘রবিবার’ appeared first on Sangbad Pratidin.