বিশ্বদীপ দে: একেক জন মানুষ থাকেন যাঁরা জীবদ্দশাতেই রোদ-জল-হাওয়ার মতো হয়ে ওঠেন। পেলে (Pele) ছিলেন তেমনই একজন। সেই কবে সাতের দশকেই বুটজোড়া তুলে রেখেও এতদিন পর্যন্ত জনপ্রিয়তায় মারাদোনাকে টক্কর দিয়ে যাওয়া মুখের কথা ছিল না। ১৯৮৬ সালে দিয়েগোর আগমন যে বাকি বিশ্বের মতো ভারতেও ‘কালো মুক্তো’কে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আগের প্রজন্ম আজও বলে যান, ইডেনে (Eden Gardens) তাঁরা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই পেলেকে যে মেজাজে দেখেছেন তার কাছে বাকিরা ম্লান। এসবই আবেগের কথা। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের সেই আবেগকে যে সরিয়েও রাখা যায় না।
সেদিন মোহনবাগানের (Mohun Bagan) বিরুদ্ধে পেলের খেলায় সকলের মন ভরেনি। মাঠে কাদা ছিল। কিন্তু হিরের গায়ে কাদা লাগলেও আচমকা ঝলকানিকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি তাঁদের। সেই ঝলকানির রেশ আজও লেগে রয়েছে তাঁদের চোখে। পেলে নেই। আজ তাই নতুন করে সেই অনেক পিছনে ফেলে আসা অতীত জেগে উঠছে চোখের সামনে। কেমন ছিল দিনটা? প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরিসংখ্যানবিদ ও ক্রীড়া সাংবাদিক হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় কী বলছেন শোনা যাক, ”ভারতবর্ষের মাটিতে কোনও ফুটবলারকে ঘিরে এ জিনিস হয়নি। ফুটবলারই বা কেন, কোনও রাষ্ট্রনায়ককে ঘিরেই হয়নি। সে যে কী উন্মাদনা! যেদিন পেলের বিমান নামল দমদমে, তাঁকে দেখতে পাগলের মতো ভিড়! মনে পড়ে ভিআইপি রোড দিয়ে পাগলের মতো লোক ছুটছে। ভিড়ে এয়ারপোর্টে সব ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। শেষে পিছন দিয়ে তাঁকে বের করা হয়।”
কেমন ছিল মাঠে পেলের পারফরম্যান্স? কাদাভরা মাঠে বছর সাঁইতিরিশের মহাতারকা সেভাবে ছুটতে পারছিলেন না। তবু তার মধ্যেই বল ধরা-ছাড়া, নিপুণ পাস- সব মিলিয়ে শৈল্পিক ছোঁয়ার হীরক দ্যুতি কিন্তু কম ছিল না। সেটুকুই প্রাণভরে দেখেছিলেন মাঠে হাজির দর্শকরা। তারপর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধীরে ধীরে সেই রূপকথা আরও নতুন নতুন ডাইমেনশন পেয়েছে। ম্যাচের ধারাবিবরণী দেওয়ার সময় অজয় বসু নাকি টইটম্বুর ইডেনের গ্যালারি সম্পর্কে বলতে গিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’র লাইন- ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী’… বহু মানুষ যে অনেক চেষ্টা করে সেই ম্যাচে মাঠে যাওয়ার ছাড়পত্রটি জোগাড় করে উঠতে পারেননি! আর যাঁরা ছিলেন? তাঁরা সারা জীবনের মতো সঞ্চয় করে রেখেছিলেন সেই টিকিট।
কসমসের হয়ে কেবল পেলে নয়, আসার কথা ছিল বেকেনবাওয়ারেরও। তিনি পায়ের চোটের কারণে মাঝপথ থেকে ফিরে না গেলে ইডেনের ঐশ্বর্য যে আরও বাড়ত তাতে সন্দেহ নেই। শক্তিশালী কসমসের সঙ্গে মোহনবাগান ২-২ ড্র করেছিল। কেমন খেলেছিলেন শ্যাম থাপা, হাবিবরা? এককথায় বললে, তাঁরা অসাধারণ খেলেছিলেন। সমানে সমানে টক্কর নয়, কার্যত কসমসের ফুটবলারদের কাদা মাঠে তাঁরা নাস্তানাবুদই করে ছেড়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সেই খেলায় সবুজ-মেরুনেরই জেতার কথা। কিন্তু একেবারে শেষে রেফারি একটি ‘অন্যায়’ পেনাল্টি দিয়েছিলেন বলেই পেলেরা খেলায় সমতা ফেরানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।
অবশ্য এতদিন পরে খেলার ফলাফল নয়, বরং কিছু ঝলকই যেন চিরকালের জলছবি হয়ে রয়ে গিয়েছে। ফুটবল সম্রাটের পা থেকে বল তুলে নিচ্ছেন বঙ্গতনয় শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়- এই দৃশ্য কেবল মোহনবাগান ফ্যানদের কাছে গর্বের মুহূর্ত নয়। বলা যায়, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের কাছেই গায়ে কাঁটা দেওয়া এক ছবি। অশীতিপর পেলের মৃত্যু যেন অতীতের সেই উজ্জ্বল অধ্যায়কে আরও একবার জীবন্ত করে দিয়ে গেল। মনে করিয়ে দিয়ে গেল, সেই সাতের দশকের সোনালি দিনগুলোর কথা। যে দিনগুলোও পেলের মতোই চিরকালীন। কখনও হারাবে না।