অণ্বেষা অধিকারী: এসআইআর। নিতান্তই সাদামাটা এই তিনটি অক্ষর নিয়ে আজ গোটা দেশ তোলপাড়। আদালতে শুনানি চলছে। জনপ্রতিনিধিরা সংসদে গলা ফাটাচ্ছেন। আর আমজনতা মাথার চুল ছিঁড়ছেন, কীভাবে এসআইআর ফর্মটা ফিলাপ করতে হবে। সবমিলিয়ে এসআইআর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সকলে। তারমধ্যেই এসে পড়েছে বছরের শেষ উৎসব-বড়দিন। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আনন্দে মাতেন সকলেই। কিন্তু অনেকেই জানেন না, দুহাজার বছর আগে যিশুর জন্মের সময়েও ঘটেছিল এসআইআরের মতো এক বিরাট কাণ্ড। নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল অতি সাধারণ মানুষকে।
ঠিক কী ঘটেছিল দুহাজার বছর আগে? যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেম তখন চলে গিয়েছে রোম সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জেরুশালেম, নাজারেথের মতো ইহুদি শহরগুলি। স্বজাতির রাজা থাকলেও ইহুদিদের উপর চলছে রোমীয় শাসন। সেই সময়েই রোমান রাজার প্রতিনিধি হুকুম দেন, গোটা সাম্রাজ্যজুড়ে শুরু হবে 'এসআইআর' বা নাগরিকদের নাম নথিভুক্তি। সেই সময়ের বর্ণনা খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে বাইবেলে। যিশুর জন্মের সময়টা ঠিক কেমন ছিল, সেই ছবি তুলে ধরতে গিয়ে লুকের সুসমাচারে লেখা রয়েছে, 'সেই সময়ে আগস্ত কৈসরের নিকট হইতে এই আদেশ বাহির হইল যে, সমুদয় পৃথিবীর লোক নাম লিখিয়া দিবে।' সমগ্র পৃথিবী অর্থাৎ গোটা রোম সাম্রাজ্য। তৎকালীন শাসক অগাস্টাস সিজার নির্দেশ দেন, তাঁর অধীনে যত নাগরিক রয়েছেন, সকলকে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। তার ফলে সঠিক জনসংখ্যা জানা যাবে। এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের সংখ্যা নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী নতুন কর কাঠামো তৈরি করা। সম্পত্তির পরিমাণ বুঝে কর বসানোর পরিকল্পনা ছিল সিজারের।
বর্তমানে যেমন এসআইআর নিয়ে আমজনতার মনে ত্রাহি ত্রাহি দশা, যিশুর জন্মের সময়েও একইভাবে বিপাকে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষ। বাইবেল বলছে, ওই সময়ে যিশুর দেশ ছিল রোমান সিরিয়া প্রদেশের অধীনে। রোমান সিরিয়ার শাসনের ভার ছিল কুরিনিয়াসের অধীনে। বাইবেল বলছে, 'সুরিয়ার শাসনকর্তা কুরীণিয়ের সময়ে এই প্রথম নাম লেখানো হয়। সকলে নাম লিখিয়া দিবার নিমিত্তে আপন আপন নগরে গমন করিল।' অর্থাৎ নিজের জন্মস্থানে গিয়ে নাম লেখাতে হয়েছিল আমজনতাকে। যিশুর বাবা যোসেফ এবং মা মেরি কর্মসূত্রে থাকতে নাজারেথে। কিন্তু যেহেতু তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বেথলেহেমের, তাই নাম নথিভুক্তির জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়েছিল বেথলেহেমে। বাইবেল অনুসারে, নাম নথিভুক্তির জন্য মেরি যখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছেন, তখন তিনি গর্ভবতী। নাম নথিভুক্তির জন্য বেথলেহেমে এত ভিড় হয়েছিল যে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও পাননি যোসেফ-মেরি। অবশেষে গোয়ালঘরে জন্ম নেন যিশু।
তবে ইতিহাসবিদরা যা বলেন সেটা বাইবেলের থেকে একটু আলাদা। বাইবেল বলছে, যিশুর জন্মের সময় যিহুদা অর্থাৎ রোমান সিরিয়া প্রদেশের রাজা ছিলেন হেরোদ। ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, তাঁর মৃত্যু হয় ৪ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ যিশুর জন্মের চার বছর পরে। তারও দু'বছর পর রোমান সিরিয়া প্রদেশের শাসনভার পান রোমীয় আধিকারিক কুরীণিয় (কুরিনিয়াস)। ৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দায়িত্ব পেয়েই শুরু করেন নাম নথিভুক্তির কাজ। অর্থাৎ ততদিনে যিশুর ৬ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ যিশুর জন্মমুহূর্তেই তৎকালীন এসআইআর বা নাম নথিভুক্তির মহাযজ্ঞটা ঘটেনি। কিন্তু তাঁর জীবনের একেবারে শুরুতে ঘটেছিল এমন এক কাণ্ড, যা কিনা দুহাজার বছর পেরিয়ে এসআইআরের মতো আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে যেমন এসআইআরের তুমুল বিরোধিতা চলছে, ইহুদিরাও সেসময়ে নাম নথিভুক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন। রোমের শাসন মানতে না চেয়েই শুরু হয়েছিল এক বিদ্রোহ। আর আমজনতা চিন্তায় ছিলেন, নাম নথিভুক্ত হবে তো? আর নাম নথিভুক্ত হলে বা না হলে কী ভোগান্তি পোহাতে হবে?
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, বাইবেলে কেন তথ্যবিকৃতি ঘটানো হল? ইতিহাসবিদদের একটা অংশ মনে করেন, যিশুর জন্ম নিয়ে বাইবেলে বহু ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। মীখা ভাববাদী পুস্তকে বলা হয়েছিল, 'আর তুমি, হে বৈৎলেহম-ইফ্রাথা, তুমি যিহূদার সহস্রগণের মধ্যে ক্ষুদ্রা বলিয়া অগণিতা, তোমা হইতে ইস্রায়েলের মধ্যে কর্ত্তা হইবার জন্য আমার উদ্দেশে এক ব্যক্তি উৎপন্ন হইবেন।' অর্থাৎ যিশু যে বেথলেহেমেই জন্মগ্রহণ করবেন সেটা পূর্বাভাস করা হয়েছিল অন্তত ৮০০ বছর আগে। রাজা ডেভিড রচিত গীতসংহিতাতেও রয়েছে যিশুর জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী। গীতসংহিতা ৮৭:৬ পদে বলা হয়েছে, 'সদাপ্রভু যখন জাতিগণের নাম লিখেন... এই ব্যক্তি তথায় জন্মিল'। অর্থাৎ নাম নথিভুক্তির সময়ে জগতে আবির্ভাব হবে যিশুর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুসমাচার রচয়িতারা চেয়েছিলেন এই দুই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করে যিশুর আগমনবার্তা জগতের কাছে তুলে ধরতে। সেকারণেই খানিকটা কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়। তাই ঠিক জন্মমুহূর্তে না হলেও যিশুর ছোটবেলায় আমজনতা ব্যস্ত হয়েছিলেন নাম নথিভুক্তি ঘিরে, ঠিক আজকেরই মতো।
