সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যেমন আছ, তেমনি এস আর কোর না সাজ’- চিরায়মানা যে কোনও সার্থক শিল্পই দাবি করে এই আভরণহীনতা৷ খাড়া দেওয়ালের জ্যামিতি ভেঙে দিতে বন্য লতাটি যখন মাথা তোলে, শিল্পের সেই সরলতাটুকুর জন্যই পিপাসুর কাঙালপনা থেকে যায় আজীবন৷ রক্তকরবীর রাজা দুর্গমের থেকে হীরে, মাণিক আনতে পারে, কিন্তু সহজের থেকে সবুজ জাদুটুকু কেড়ে আনতে পারে না৷ এই জাদুটুকুই তিরের মতো বুকে এসে বেঁধে,- যেমন মান্না দে-র গান৷ ওস্তাদের কালোয়াতি অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু স্বরলিপি ভুল করা শেষের সে গান স্মৃতির বীণায় না সাধতে বলার যে আকুতি, তা পণ্ডিতের পুঁথিতে ধরা পড়ে না৷ তা একান্তই ভাবের খেলা৷ সবরকমের ওস্তাদি জানা সত্ত্বেও কী আশ্চর্য সংযমে ও ভাবালুতায় তিনিই পারেন নিরালায় বসে স্মরণবীণ বাঁধার এ কাজটি৷ আর কী বেদনার মতো বেজে ওঠে আমাদের প্রতিটি দিন!
আচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে থেকে শুরু করে উস্তাদ দাবির খাঁ সাহেব- কার কাছে না তালিম নেননি! কোন শৈলীতে না নিজেকে মেলে ধরেননি! কীর্তন থেকে কাওয়ালি-কে আর অমন করে গাইতে পেরেছেন! বিষাদ থেকে বিলিতি মেলডি-কে আর এমন করে শ্রোতাদের নিয়ে যেতে পেরেছেন ভারতীয় সংগীতে! এত বৈচিত্রের এক আশ্চর্য সংহতি হয়েও তিনি অপরূপ নির্লিপ্ত৷ ধ্রুপদী শিক্ষাই বোধহয় তাঁকে শিখিয়েছিল এই অসামান্য সংযম৷ সেদিনের বম্বেতে বিখ্যাত কাকার সহকারী হয়ে যখন তিনি কাজ করে চলেছেন বা পরবর্তী জীবনে শচীনদেব বর্মণের সহকারী থাকার সময়ও, ব্যক্তিগত জীবনেও রেওয়াজ করেছেন এই সংযমেরই৷ কেননা তাঁরই তোলানো গান গেয়ে খ্যাতিমান হচ্ছে অন্য শিল্পীরা৷ হিন্দি গানের আকাশে জ্বলজ্বল করছেন রফিসাহেব ও মুকেশের মতো দুই নক্ষত্র৷ অথচ দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তিনি থেকে গিয়েছিলেন নিভৃতে৷ ‘উপর গগন বিশাল’ গাওয়ার পর শচীনদেব বলেছিলেন, ছবি দেখে আসতে৷ সাধ করে দেখতেও গিয়েছিলেন৷ গিয়ে দেখলেন এক বুড়ো সন্ন্যাসীর লিপে রয়েছে তাঁর গান৷ নায়কের নেপথ্য কণ্ঠ যেন তাঁর অধরাই৷ কাব্যে উপেক্ষিতা হয়েও ওই সংযমের শিক্ষাই তাঁকে সংগীত থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি৷ পরবর্তীতে তিনিই সেই বিরল শিল্পী যিনি রাজ কাপুর ও উত্তমকুমারের মতো দুই তাবড় নায়কের লিপে গান গেয়েছেন৷ উপেক্ষা-বঞ্চনার মুখোমুখি হয়েছিলেন বলেই বোধহয়, ভুল কীসে না বুঝে মাশুল দেওয়ার যন্ত্রণা এমন বিষাদময়তায় বেজে উঠেছিল তাঁর কণ্ঠে৷ সব হারিয়েও হিসেবের শূন্য না মেলার বেদনা তিনি জানতেন বলেই, সেই আর্তিকে সরগম করে তিনিই ঘটাতে পারেন রক্তক্ষরণ৷
এই সংযম তাঁর সংগীতেও৷ ধ্রুপদী শিক্ষার জোর তিনি কখনও দেখাতে যাননি৷ ভাটিয়ার থেকে ভাবের জোরেই ‘এ কী অপূর্ব প্রেম’কে তিনি মোহময় করে তুলেছেন৷ ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র আর পাঁচটা গানের পাশাপাশি কে ভুলতে পারে ‘তুই আমায় দয়া করবি কি না বল’ গানটিকে৷ যে দরদ নিয়ে তিনি ছবিতে শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার৷ অসংখ্য গানের সঞ্চারী থেকে অন্তরাতে ফেরার সময় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন কোন জাতের দক্ষতা থাকলে অমন সহজে ফেরা যায়৷ অথচ কালোয়াতি তিনি করেননি৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের মায়াবী পেলবতা তাঁর নেই, নেই মুকেশের মতো কণ্ঠের রোম্যান্টিকতা, আর তিনি নিজেই তো বলেন, রফিসাব তাঁর থেকে নাকি অনেক ভাল গায়ক৷ তাহলে কোথায় তিনি মান্না দে? ওই যে ‘পুঁছো না ক্যায়সে মেরে’র আর্তি, ওই যে পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে বলতে গিয়ে তিনি ‘আসবে’র উচ্চারণে যে একখানা আস্ত ছোটগল্প লুকিয়ে রাখতে পারেন, সঙ্গীতপ্রেমী মাত্রই জানে ঠিক সেখানেই তিনি মান্না দে৷
কালোয়াতি ছাড়িয়ে ভাবের আঙিনায় ভাসাতে তিনি ওস্তাদ৷ আবার বাঙালির ধ্রুপদীপ্রেমের সখ মিটিয়েই গেয়ে দেন ‘ললিতা গো ওকে আজ চলে যেতে বল না’র মতে গান৷ বরাবরই প্রথমের আসন তিনি পাননি৷ আসামান্য দক্ষতা, ভার্সাটিলিটি নিয়েও একটু পিছনেই থেকে যেতে হয়েছে তাঁকে৷ তবু আজও বিরহের কথা এলে বুকের জ্বালা ভুলতে বাঙালি যে তাঁরই গান দিয়ে স্মৃতির দুয়ার খুলবে, তা আর আশ্চর্যের কী! ভালবাসার রাজপ্রাসাদে মুকুট শুধু পড়ে থাকে, রাজাই তো নেই৷ বাঙালির অন্তত সে দুর্ভাগ্য নেই৷ শ্যামলে সবুজ উত্তম এ বঙ্গের হেমন্ত থেকে বর্ষায় বাঙালির ভালবাসার প্রাসাদে একজন রাজা থেকেই যান-তিনি মান্না দে৷
The post বাঙালির ভালবাসার রাজপ্রাসাদে আজও তিনি মুকুটহীন রাজা appeared first on Sangbad Pratidin.