বিশ্বদীপ দে: বাঙালির বড় কাছের, ‘হাসিকান্নার সাথী’ হয়েই ছিলেন নির্মলা মিশ্র (Nirmala Mishra)। শনিবার গভীর রাতে যখন খবরটা ছড়িয়ে পড়ল, ধীরে ধীরে মনকেমনের এক সংগীত যেন বেজে উঠল মনের কোণে। তিনি নেই। গত কয়েক বছরের দীর্ঘ রোগভোগের যন্ত্রণা শেষে পাড়ি দিলেন কখনও না ফেরার দেশে। কণ্ঠও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বহুদিন। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতা, যাঁদের সঙ্গে ‘ব্যক্তি’ নির্মলার কোনও পরিচয় ছিল না, তাঁদের সঙ্গে কিংবদন্তি শিল্পীর সংযোগ কখনওই ছিন্ন হয়নি। মা-হারা সন্তান আজও ইউটিউবে ‘ও তোতাপাখি রে’ শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সেই পবিত্র অশ্রুর নির্মাতা নির্মলা ছিলেন বাঙালির সঙ্গে, থেকে গেলেন তাদের ‘হাসিকান্নার সাথী’ হয়েই। জাগতিক মৃত্যু সেই সংযোগকে কেড়ে নিতে পারবে না।
২০২২ সালে বাঙালি হারিয়েছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। হারিয়েছে বাঙালি না হয়েও বাঙালির আপন হয়ে ওঠা লতা মঙ্গেশকরকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহমান সুরেলা মোহময় আবেশের স্রষ্টা তাঁরা। এবার চিরবিদায় নির্মলার। তিনিও বহু প্রজন্মের বড় আপন এক শিল্পী। তাঁর প্রয়াণ কেবল একজন সংগীতশিল্পীর চলে যাওয়া নয়। বলা যায়, যেন এক হারানো কালখণ্ডের মহা গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলকের চিরকালের জন্য কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া।
[আরও পড়ুন: দিল্লিতে চার বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন মমতা! সাক্ষাৎ হতে পারে সোনিয়ার সঙ্গেও]
গত কয়েক দশকে বাঙালি অনেক বদলেছে। রেডিওয় ‘অনুরোধের আসর’, জলসায় জলসায় হেমন্ত-সন্ধ্যা-মান্না-নির্মলা-শ্যামলের কণ্ঠ সঙ্গে করে যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁদের কাছে এই নতুন সময়টা একেবারেই আনকোরা ঠেকে। পুরনো সময়কে ফিরে পেতে হাতের স্মার্টফোন কিংবা ডেস্ক টপে আজও তাঁরা শোনেন সেই সব মায়াবী কণ্ঠ। একে একে জাগতিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন এই শিল্পীদের অনেকেই। কিন্তু তাঁদের কণ্ঠের মাধুর্য আজও অনুপম তরঙ্গ হয়ে রয়ে গিয়েছে মনের কাছাকাছি। সেই তালিকায় রয়েছেন নির্মলাও।
‘ও তোতাপাখি রে’র কথা কেউ ভুলবে না। একই ভাবে ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’র আবেদনও হৃদয়ের তন্ত্রীতে অমোঘ টান দিতে থাকে অবিরল। ‘বলো তো আরশি’, ‘আমি তো তোমার’ কিংবা ‘এই বাংলার মাটিতে’… তালিকা আরও অনেক অনেক দীর্ঘ। প্রতিটি গানের গায়েই লেগে রয়েছে ফেলে আসা সময়ের সুঘ্রাণ। পুজোর প্যান্ডেলে আজও এই গানগুলির কোনও একটি বেজে উঠলেই যে অনুভব জন্ম নেয়, তাকে ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়াস নেহাতই অনর্থক। নির্মলা চলে গেলেন। তবু আরও বহু বহু দিন বাঙালির প্রত্ন সময়ের এক অমলিন প্রতিনিধি হয়ে থেকে যাবেন তিনি। সুদূর নক্ষত্র নয়, বাংলা গানের আকাশে চিরকালীন এক তোতাপাখি হয়ে।