বিশ্বদীপ দে: এক যে ছিল সময়। যে কোনও রূপকথার গল্পের মতোই ভারতীয় ফুটবলেও একটা এমন সময় ছিল। যখন জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলকে হারিয়ে দিতে পারত ভারত! ভারতীয় ক্রিকেটে যেমন ১৯৮৩, এদেশের ফুটবলেও তেমনই একটা বছর ১৯৬২। যেবার জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিলেন পিকে-চুনী-বলরাম-জার্নেল সিংরা। আর তাঁদের কোচ ছিলেন কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম। সেই অসামান্য সাফল্যই এবার রুপোলি পর্দায়। ইতিহাসকে 'জীবন্ত' করে তুলতে কতটা সফল হল 'ময়দান' (Maidaan)?
বেশ কয়েক বছর ধরে বলিউডে অধিকাংশ 'স্পোর্টস মুভি' দারুণ সাফল্য পেয়েছে। মিলখা সিং থেকে মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবন বা ১৯৮৩ সালে কপিলদের বিশ্বজয়- ভালোই দর্শক আনুকূল্য পেয়েছে। কিন্তু বাংলায় 'গোলন্দাজে'র মতো ছবি হলেও ফুটবল টিনসেল টাউনে প্রায় ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে। অজয় দেবগন অভিনীত এই ছবি বোধহয় সেই অভাব পূরণ করে দেবে। এই ছবির নিউক্লিয়াস কিন্তু অজয় অভিনীত রহিম সাহেবই। তিনি এমন এক চরিত্র, যাঁকে ঘিরে 'লার্জার দ্যান লাইফ' একটা দ্যুতি রয়ে গিয়েছে আজও। শরীরে কর্কটরোগ নিয়েও দেশকে সাফল্য এনে দিতে মরিয়া মানুষটিকে সত্যিই কেমন 'অপার্থিব' মনে হয়। এমন এক মানুষ আজ বিস্মৃতপ্রায়। অজয়ের দুরন্ত অভিনয় তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে 'জীবন্ত' করে তুলবেই।
[আরও পড়ুন: মোসাদের ধাঁচে পাকিস্তানে জঙ্গি নিকেশ! ভারতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে মুখ খুলল আমেরিকা]
ছবির শুরুতে দেখা যায় ১৯৫২ সালের অলিম্পিকে যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে ভারতের ম্যাচের দৃশ্য। একের পর এক গোল খেয়ে ১-১০ চূর্ণ হয় সদ্য স্বাধীন দেশ। জোরালো হতে থাকে কোচকে তাড়ানোর দাবি। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী রহিম সাহেব বোঝান, একে তো ঘরোয়া ফুটবল ৭০ মিনিটের। যেখানে আন্তর্জাতিক ফুটবল ৯০ মিনিটের। তার উপর তখনও পর্যন্ত খেলোয়াড়রা খেলেন খালি পায়ে। তাছাড়া পুরনো 'তারকা'দেরই খেলিয়ে যেতে হয়, সম্ভাবনাময় তরুণ তুর্কিদের না খেলিয়ে। এই সমস্যাগুলো কাটাতে পারলেই সাফল্য সম্ভব। এর পর শুরু হয় রহিমের 'লড়াই'।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তিনি জোগাড় করতে থাকেন আগামির তারকাদের। হায়দরাবাদের এক বস্তি এলাকায় তিনি খুঁজে পান তুলসিদাস বলরামকে। তাঁকে মুগ্ধ করেন বাংলার দুই তরুণ স্ট্রাইকার। একজন শট মেরে জাল ছিঁড়ে দেন। অন্যজন গোলপোস্টের সামনে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার পর ব্যাক কিক করে গোল করেন। প্রথমজন পিকে ব্যানার্জি (P K Banerjee), দ্বিতীয়জন চুনী গোস্বামী (Chuni Goswami)। এই বঙ্গদেশের সর্বকালের সেরা দুই মহাতারকা। দলে আসেন গোলকিপার দীর্ঘদেহী থঙ্গরাজ। কালক্রমে সেই দলই এনে দেয় 'সোনার' সাফল্য। কিন্তু সেই সাফল্য একদিনে আসেনি। কঠিন সমালোচনার মধ্যে লড়াই করতে হয়েছে। রহিম সাহেবকে পড়তে হয়েছে কর্মকর্তাদের 'রাজনীতি'র মুখে।
[আরও পড়ুন: মাত্র চার মাসে ১১! ফের আমেরিকায় মৃত ভারতীয় পড়ুয়া]
এই ছবিতে রুদ্রনীল ঘোষ ও গজরাজ রাও রয়েছেন খল চরিত্রে। গজরাজ যথারীতি মুগ্ধ করেন। কেবল মৌখিক অভিব্যক্তিতেই রীতিমতো 'হাড় জ্বালানো' অভিনয় করতে জানেন তিনি। অন্যদিকে রুদ্রনীলও বলিউড অভিষেকে চমকে দিয়েছেন। ক্রুর হাসি, ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গির মিশেলে তিনিও খুবই ভালো। কিন্তু চরিত্রটি বড়ই একরৈখিক বলে মনে হয়। রুদ্রনীলের 'শুভঙ্কর'কে আরও একটু 'শেড' কি দিতে পারতেন না চিত্রনাট্যকাররা? ছবিতে সকলের অভিনয়ই চমৎকার। অজয়ের (Ajay Devgn) স্ত্রীর চরিত্রে প্রিয়মণি যতটুকু স্ক্রিন স্পেস পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করেছেন। পিকে, চুনী, বলরাম, থঙ্গরাজ, প্রদ্যুত বর্মনের চরিত্রাভিনেতারাও প্রত্যেকে বেশ ভালো। কিন্তু ছবির আসল ফোকাস থেকেছে অজয়ের উপরেই। তিনি সেটাকে কাজেও লাগিয়েছেন অব্যর্থ ভাবে। এই ছবিকে অজয় দেবগনের 'শ্রেষ্ঠ' কাজ বলা যাবে কিনা তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু 'অন্যতম সেরা' যে, তা হলফ করে বলা যায়। বিষণ্ণতা থেকে জেদ, ক্ষোভ থেকে অসহায়তা- নিজের ঝুলি উপুড় করে দিয়েছেন অভিজ্ঞ অভিনেতা। পরিচালক অমিত শর্মা যেন ধরেই নিয়েছিলেন এই ছবি টানতে গেলে তাঁকেই লাগবে। সেই বিশ্বাসের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন অজয়।
কিন্তু কোথাও সেটাই কিছুটা হলেও ছবির গল্পের ক্ষতি করেছে। 'চক দে ইন্ডিয়া'র মতো ছবিতে শাহরুখ খানকে যথেষ্ট স্পেস দিয়েও সাবপ্লটগুলিও যত্ন সহকারে তৈরি করা হয়েছিল। ফলে সকলের সঙ্গেই দর্শকের একটা সংযোগ তৈরি হয়। সেটা এই ছবিতে হয়নি। একমাত্র তুলসিদাস বলরামের ব্যাকগ্রাউন্ড কিছুটা হলেও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাকিদের সেভাবে জায়গা দেওয়া হল কই? অল্প বয়সে পিকের পিতৃহারা হওয়ার প্রসঙ্গ এলেও তাকে বিস্তৃতি দেওয়া হয়নি। একই ভাবে চুনী গোস্বামীর মতো কিংবদন্তির ব্যক্তিগত জীবন দেখানো হল না। একই কথা বাকিদের ক্ষেত্রেও। তাই এই ছবিকে রহিম সাহেবের বায়োপিক বললে অত্যুক্তি হয় না। আর একটা আক্ষেপ। কলকাতা এই ছবির কেন্দ্রে রয়েছে। তবু সেই ভাবে গত শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকের গোড়ার মহানগরকে দেখানো হয়নি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গানের পঙক্তি কিংবা ট্রামের দৃশ্যে যেন মন ভরে না। অথচ এই ছবিতে কলকাতা একটা চরিত্র হয়ে উঠতেই পারত। এছাড়া ছবির একটি গানে 'টিম ইন্ডিয়া' কথাটা কেমন কানে লাগে। এর ব্যবহার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সেই সোনালি পারফরম্যান্সের সময় উদ্ভূত। ছয়ের দশকে কি এই শব্দবন্ধ ছিল?
তবে এটুকু বাদ দিলে এই ছবি মুগ্ধ করবেই। এ আর রহমানের সঙ্গীত 'ময়দানে'র সম্পদ। বিশেষ করে খেলার মুহূর্তে আবহ সংগীতের ব্যবহার 'ম্যাজিক' তৈরি করে পুরোদমে। গানগুলিও বেশ ভালো। খেলার দৃশ্যগুলো যেভাবে শুট করা হয়েছে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ছবির প্রথমার্ধে কোথাও কোথাও গতি সামান্য রুদ্ধ হলেও দ্বিতীয়ার্ধ জমজমাট। বিশেষ করে জাকার্তায় পৌঁছনোর পর অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ আপনাকে পৌঁছে দেবেই স্টেডিয়ামে। ফাইনালে মাঠে নামার আগে তাঁর দামাল ছেলেদের সামনে অজয়ের সংলাপে গায়ে কাঁটা দেয়। 'চক দে'র সেই বিখ্যাত 'সত্তর মিনিটে'র কথা মনে পড়তে বাধ্য। কিন্তু অজয়ের চরিত্রটির বিপন্নতা আরও বেশি। ফলে দর্শকের আবেগে তা অন্য মাত্রা যোগ করে।
এই ছবি ইতিহাসের। আবার এই ছবি স্বপ্নও দেখায়। এমন স্বপ্ন, যা একদিন সত্যি হয়েছিল। কিন্তু তার পর সব কেমন বদলে গেল! তাই এই ছবির আসল মুহূর্ত বুঝি তৈরি হয় যখন বাস্তবের সেই নায়কদের পর্দায় দেখানো হয়। সেই মুহূর্তগুলোয় বয়ঃপ্রান্তে পৌঁছনো পিকে-চুনীদের দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায়। মনে হতে থাকে, এমন গৌরবময় ইতিহাস কেন শেষপর্যন্ত থমকে গেল! দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ভারতের নাগাল ছাড়িয়ে অনেকটা দূর চলে গিয়েছে। আমরা কি ফিরে পাব না সেই হারানো গৌরব? পরিচালক অমিত শর্মা এই প্রশ্নকে জীবন্ত করে তুলতে পুরোপুরি সক্ষম। এমন ছবির সফল না হওয়াই তাই আশ্চর্যের।