বিশ্বদীপ দে: গথাম শহর বিপদে পড়লে ব্যাটম্যানকেই দরকার। আর কলকাতা? তার বিপদে প্রয়োজন কেবল গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জিকে। কেননা অন্যরা যে ড্রয়িংরমে গোল হয়ে বসে রহস্য সমাধান করেন! কিন্তু হারিয়ে যাওয়া সময়ের গোয়েন্দা কি আদৌ ফিরে আসতে আগ্রহী? তাকে বলা হয়, এই শহরের তোমাকে প্রয়োজন। সে সটান জানিয়ে দেয়, ”এই শহরটাকে আমার আর দরকার নেই।” তাহলে শহরকে বাদামি হায়নার কবল থেকে কে বাঁচাবে? দীপক কি মত বদলাবে? বিস্মৃত লেখক স্বপনকুমার কি তাঁর কলমের খোঁচায় ফের অভিযানে পাঠাবেন অভিমানী দীপককে? এই জায়গা থেকেই শুরু হয় দেবালয় ভট্টাচার্যের ‘শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে’ (Shri Swapankumarer Badami Hyenar Kobole)। শেষ পর্যন্ত কতটা জমে দীপক চ্যাটার্জি-রতনলালের অ্যাডভেঞ্চার?
২০০১ সালেই মারা গিয়েছিলেন সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। যিনি ‘শ্রীস্বপনকুমার’ ছদ্মনামে প্রায় তিন-সাড়ে তিন দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন বাঙালিকে। কিন্তু ফেলুদা-ব্যোমকেশের কৌলিন্য যেমন দীপক পায়নি, সাহিত্যিকের মর্যাদাও পাননি তার স্রষ্টা। তবু মৃত এই শহরে একমাত্র কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতেই এখনও কীভাবে রয়ে গিয়েছে সস্তা কাগজে ছাপা বইগুলো। আর তাই সেখানেই আটকে রয়েছে দীপক। আচমকাই তার কাছে ফোন আসে। শহরে আসছে ‘বাদামী হায়না’। যার প্রাণভোমরা লুকনো রয়েছে এক কৌটোয়। শুরু হয় অ্যাডভেঞ্চার। আর রক্তমাংসের লেখকের মৃত্যুর দুদশক পরে ফের লিখতে বসে পড়েন প্রৌঢ় শ্রীস্বপনকুমার! উত্তেজনায় ফুটছেন তিনি। ‘স্নো হোয়াইট কোল্ড স্টোরেজে’ দুষ্কৃতীদের মোকাবিলায় অবশেষে দেখা মেলে গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির। কিন্তু লেখকের পুরনো অভ্যাস যায় কোথায়? একবার নায়ক হেঁটে যায়, একবার বাইকে। সেই ‘গাঁজাখুরি’ ট্রিটমেন্ট চলতেই থাকে! গোয়েন্দা রেগে ওঠে স্রষ্টার বিরুদ্ধে। তবু সে তো অসহায়। তার গায়ে গুলি লাগলেও ততক্ষণ রক্তক্ষরণ হবে না, যতক্ষণ না লেখকের কলম সেটা লিখছে!
[আরও পড়ুন: যিনি স্বপন কুমার, তিনিই শ্রীভৃগু! গোয়েন্দা গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর খোদ লেখকের জীবনও]
এই ছবির যে মূল গল্প তা আসলে সাদা কাগজে একজনের ফুটিয়ে তোলা গল্প। আর তাই সেই গল্পে যে কলকাতাকে আমরা দেখি তা যেন আমাদের রোদ-জলের কলকাতা নয়। ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা…’ তা যেন এক আয়নাশহর। যে শহরে দীপক চ্যাটার্জি এলে বৃষ্টি নামে। রাতের বেলা প্লাস্টিকের ব্যাগে রঙিন মাছ হাতে একেক দিন একেক বেশে হেঁটে যায় এক রহস্যময়ী। যার কান্নার জল গড়িয়ে পড়ে কাচ হয়ে। অন্যদিকে এক চিনা দাঁতের ডাক্তার ড. চিং ও তার স্যাঙাৎরা ষড়যন্ত্রের প্যাঁচ কষছে। ধীরে ধীরে সব পাকানো জট খুলতে থাকে দীপক। কিন্তু স্রষ্টার কাছে তার আর্জি, আগের মতো করে লিখলে হবে না। নিজের লেখাকে ‘সাহিত্য’ করে তুলতে হলে শ্রীস্বপনকুমারকে লেখায় জুড়তে হবে মগজাস্ত্র, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ইতিহাস! হোক না সে ইতিহাস নেহাতই আজগুবি।
ছবিজুড়ে হিউমারের ছড়াছড়ি। যেমন ‘একুশ শতাব্দীতে বাঙালির শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার গন্ধরাজ মোমো’। কিংবা ‘ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে’ গানটিকে আবহে রেখে অ্যাকশন! আর প্রায় সবক্ষেত্রেই ব্যাটে বলে হয়েছে তা। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের হাততালি সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু তবুও একটা সংশয় থেকে যায়। এই ছবির ভিতরে থাকা এত স্তর পেরিয়ে শেষপর্যন্ত সত্যিই এই ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে তো? সেটা সময়ই বলবে। তবে আজকের দর্শক বিশ্বব্যাপী নানা কনটেন্ট দেখে অভ্যস্ত। এমন পরীক্ষামূলক ছবিকে তাঁরা স্বীকৃতি দিলে বাংলা ছবির পাশে প্রকৃতই দাঁড়ানো হবে। ছবিতে এই বিশেষ বক্তব্যটিকেও যদিও ‘মক’ করতে দেখা গিয়েছে দীপককে।
[আরও পড়ুন: রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য কেন ২২ জানুয়ারিকেই বেছে নেওয়া হল?]
দেবালয় ভট্টাচার্য ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন অপরিসীম যত্নে। এবং এর পর পর্দায় সেটাকে ফুটিয়ে তোলার সময়ও থেকেছেন একই রকম যত্নশীল। না হলে পাল্প ফিকশনের মেজাজ আগাগোড়া বজায় রাখা সহজ ছিল না। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত সংলাপ ভৌমিকের। তাঁর সম্পাদনা ছবিটিকে এমন ঝকঝকে করে তুলেছে, মনে পড়ে না এর আগে কোনও বাংলা ছবি এভাবে তৈরি হয়েছে বলে। ছবির আবহ সঙ্গীত ও গানও চমৎকার। বিশেষ করে ‘নির্বাসিত চাঁদ’ গানটি অনবদ্য। তার প্রয়োগও একেবারে সুপ্রযুক্ত। অভিনয়ে মন কাড়েন আবির চট্টোপাধ্যায় (Abir Chatterjee)। তিনি ছাড়া দীপককে এতটা জীবন্ত কে আর করে তুলতেন? পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Paran Bandopadhyay) বরাবরের মতোই অসামান্য। পাশাপাশি লোকনাথ দে, গৌতম হালদাররাও তাঁদের সুনাম বজায় রেখেছেন। শ্রুতি দাস, প্রতীক দত্তরাও বেশ ভালো।
সাম্প্রতিক বাংলা ছবিতে গোয়েন্দারা বার বার ফিরে আসে। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শবর বা মিতিন মাসিদের একেবারে উলটো পৃথিবীর বাসিন্দা দীপক চ্যাটার্জি ও তার শহর। যে শহরের রাতের আকাশে ধোঁয়াশা কম, ঝলমল করে ওঠে তারা। নেমে আসে ইউফো। খেলনা হেলিকপ্টার আসল হেলিকপ্টার হয়ে আকাশে উড়তে থাকে। সেই অলীক শহরের গোয়েন্দা দীপকের গল্প বলতে বসে পরিচালক আরও অনেক কথা বলেছেন। বাদামি হায়না যে আসলে কে সেকথা ফুটে ওঠে ছবির একেবারে শেষে। যা প্রায় ম্যাজিকের মতোই ফুটে ওঠে পর্দায়। আসলে পরতে পরতে ‘ম্যাজিকে’র কোনও অভাব নেই ছবিতে। যা প্রমাণ করে ‘ম্যাজিশিয়ান বুড়ো হয়ে যায়, ম্যাজিক থেকে যায়’। ছবিশেষেও সেই ম্যাজিকের রেশ থেকে যায় নিঃসন্দেহে।