shono
Advertisement

Breaking News

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের আন্তরিকতায় ‘মাই নেম ইজ জান’নাটকে জীবন্ত গওহর জানের জীবন

নাটকের তুরুপের তাসটি ছিল গওহরের নিজের কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো।
Posted: 04:20 PM Sep 19, 2021Updated: 04:28 PM Sep 19, 2021

নির্মল ধর: বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা ও অভিনেত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় (Arpita Chatterjee)। খুব পছন্দসই চরিত্র না পেলে ক্যামেরার সামনে যান না। ইদানিং সেটাও অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি ভালবাসায়, নিষ্ঠায় কোনো ঘাটতি পড়েনি। তা আবার প্রমাণিত হল জি ডি বিড়লা সভাঘরের মঞ্চে। শুধু অভিনয় নয়, নিজের পুরনো প্রেম সংগীত ও নাচের সহযোগে একক অভিনয়ের এক অনন্য নজির গড়লেন অর্পিতা।

Advertisement

এর আগেও স্বপ্ন সন্ধানী নাট্য দলে কৌশিক সেনের পরিচালনায় নাটক করেছিলেন অর্পিতা। তখনই আন্দাজ পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মঞ্চপ্রেমের। এবার সেটা পূ্র্ণ হল। ভারতীয় সংগীতের প্রথম (১৯০২) ‘রেকর্ড গার্ল’ ছিলেন গওহর জান (Gauhar Jaan)। তাঁর গান বৃটিশ কোম্পানি রেকর্ড করে নিয়ে যায়। আদতে গওহর জান বেনারসের বাসিন্দা হলেও, বৃটিশ(আর্মেনিয়ান) বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক ছেদের পর চলে আসেন দেশের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায়।

নাটকে অবশ্য বেশ কৌশল করেই লখনউয়ের নবাবের কলকাতা আসার প্রসঙ্গে টেনে তখনকার বৃটিশ রাজনীতির কূটকৌশলের কথাটিও জানিয়েছেন নাট্যকার। শুধু এই ঘটনা নয়, শাসক ব্রিটিশের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্ক, ওপরতলার (গভর্নর) চাপ দিয়ে শিল্পীদের কাজে বাধ্য করা কিংবা নারীত্বের অবমাননা, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর অসহায় অবস্থার প্রতিও পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তী পরোক্ষ আঙ্গুল তুলেছেন।

আসলে গওহর জানের নাতিদীর্ঘ জীবনটাই ছিল ঘটনাবহুল ও রঙিন। তৎকালীন কলকাতার বাঈজী পাড়ায় তিনি বেশ রইসি মেজাজেই থাকতেন, শহরের ‘মূল্যবান তওয়াফ’ ছিলেন গওহর। ছয় ঘোড়ার একমাত্র জুড়ি গাড়ি ছিল তাঁরই। হাজার টাকা ফাইন দিয়ে রোজ সেই গাড়ি নিয়ে ময়দানে হওয়া খেতে বেরোতেন। নিজের পোষা বেড়ালের বিয়ে দিয়েছিলেন কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে। আবার এই গওহর মুজরো করে পাওয়া লক্ষ টাকা বিলিয়ে দিয়েছিলেন গরীব-দুঃখীদের মধ্যে।

[আরও পড়ুন: সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পাচ্ছেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়]

নাচে-গানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সমাজপতিদের প্রশংসা ও আদর আদায় করে নিয়েছিলেন। আবার একইসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল না পাওয়ার এক শূন্যঝুড়ি। ইশক, প্রেম, ভালবাসা তওয়াফের জন্য নয়, সেটা ভাল করেই জানতেন। কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সে যে কিশোরীর রক্তাক্ত ‘নখ ভাঙা’ দিয়ে বাঈজী জীবনের শুরু, তাঁর জীবনে অবশ্যই প্রেম আসবে, এসেওছিল। বিভিন্ন রাজা, জনৈক নিমাইবাবু, মারাঠি কিশোর, কন্ট্রাক্ট বিয়ে করা স্বামী গুলাম আব্বাস থেকে তরুণ মারাঠি কিশোর অমিত কেশব নায়েক, কোনও সম্পর্কই স্থায়ী হয়নি। বারবার মানুষকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছেন ভারতীয় সংগীতের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা গওহর জান।

প্রেম তো নয়ই, ভরসা করার কোনও মানুষও গওহরজান জীবনে পাননি। বরং উলটোটাই ঘটেছে। সৎ ভাই, নিজের সচিব(যাকে হয়তোবা কিঞ্চিৎ ভালবাসতেন) থেকে গুণমুগ্ধের দল, সকলেই সম্পত্তি নিয়ে মামলা মোকদ্দমায় তাঁকে সর্বস্বান্ত করেছেন। বিধ্বস্ত গওহরকে জীবনের শেষ ক’টা দিন মহীশূরের রাজ দরবারে মাসিক মাইনের গাইয়ে হিসেবে কাটাতে হয়েছে। এরই মধ্যে গওহর জান নারীত্বের অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি আঙ্গুল তুলেছেন, যা সেই সময়ে রীতিমতো বৈপ্লবিক বলা চলে।

পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তী বিক্রম সম্পতের লেখা বই থেকে নিশ্চয়ই সাহায্য নিয়েছেন, তবে তার সঙ্গে আরও কিছু তথ্য তিনি সংযোগ করে নাটকের মধ্যে তৎকালীন রাজনীতির আবহও সুন্দরভাবে সেলাই করে দিয়েছেন। তাঁর পরিচালনার কাজ সহজ ও সরল। আত্মকথনের ভঙ্গিতে গওহারকে দিয়েই সূত্রধরের কাজটি করিয়ে নিয়েছেন। মঞ্চে অর্পিতা একাই আম্মি বড়ে মালকা জান, আব্বু ওরফে খুরশিদ চাচা, নিমাইবাবু, সৎ ভাই, রেকর্ড কোম্পানির জার্মান কর্তা সকলের অনুপস্থিতির কাজটা প্রক্সি দিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন। নাটকের চলনে শুধু মঞ্চসজ্জার প্রপস আনা নেওয়ার কাজটি ছাড়া কেউই মঞ্চে ছিলেন না।

একা অর্পিতা। নাচে-গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন আশি মিনিট সময়। বোঝাই যাচ্ছিল দীর্ঘ পরিশ্রম ছাড়া এমন পরিবেশনা সম্ভব নয়। অবন্তীর হাতে অর্পিতা নিজেকে যেমন সমর্পণ করেছিলেন, তেমনই গান, অভিনয় ও নাচের প্রতি নিজের অধ্যবসায়, ভালবাসা, নিষ্ঠাও উজার করে দিয়েছেন। অভিনেত্রীর একক অভিনয় আমরা ইতিপূর্বে একাধিক জনের দেখেছি, এমনকী গওহর জানের চরিত্রেও। কিন্তু অর্পিতা এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করলেন।

অবন্তীর হাতে তুরুপের তাসটি ছিল গওহরের নিজের কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো। ঠুমরি, খেয়াল, কীর্তন, কাজরী, এমনকী রবীন্দ্রনাথের গানও পেয়েছেন হাতের কাছেই। সংগীত পরিচালক জয় সরকারের কাজও অনেকটাই সহজ হয়েছে একই কারণে।  বিশেষ করে উল্লেখ করছি প্রথম রেকর্ড করা গান “রসকে ভরে তোরে নয়ন…”, এটা ছাড়াও “এ জমুনে…” কীর্তন গানটি, এবং অবশ্যই রবিঠাকুরের “কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না…”র নিবেদন মনকে ভিজিয়ে দেয়। তবে আবহ রচনায় জয় নিজের উদ্ভাবনী চিন্তার প্রকাশ প্রমাণ করেছেন। খোল-মৃদঙ্গের ব্যবহার পরিবেশ রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, তার কৃতিত্ব অবশ্যই জয়ের প্রাপ্য। গৌতম মির্ধার স্টেজ ডিজাইনে কোনও বাহুল্য নেই, মিনিমালিস্ট হয়েও সময়কে তুলে এনেছেন পুরনো কলকাতার ছবি দেখিয়ে।

পৌলমী গুপ্তার পোশাক পরিকল্পনায় সেই উনিশ শতকের প্রথম দিককার ফিলটা অনুভব করা যায়। আরও বিস্মিত হতে হয়, দৃশান্তরের অতি অল্প সময়ে পোশাকের অতটা পরিবর্তন করার কাজটি সুন্দরভাবে করে ফেলায়। একটি মিডিয়া সংস্থা এবং আরও একটি প্রসাধনী সংস্থার উদ্যোগে ‘মাই নেম ইজ জান’-এর (My name is Jaan) প্রথম দু’টি শো হয়ে গেল। এরপর? ‘মূল্যবান’ এমন প্রযোজনা উপস্থাপনার আর্থিক ক্ষমতা ক’জন পারবেন! তবে শিল্পী অর্পিতার গভীর আন্তরিকতায় বোনা এই নাটক একবার অন্তত দেখতেই হবে কলকাতার নাট্যপ্রেমিকদের।

[আরও পড়ুন: ওহ লাভলি! মদন মিত্রর বায়োপিকে গান গাইছেন নচিকেতা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement