কান পাতলেই শুনতে পাই অজস্র হাসির শব্দ। অথচ অসহিষ্ণুতার আগুনে পুড়ছে দেশ। কফিহাউস-এর জন্য লিখছেন ঋদ্ধি সেন।
‘যাচ্ছে না এড়ানো শেষ শুয়ে পড়াটা যাচ্ছে না থামানো শেষ কাঁধে চড়াটা
যাচ্ছে না জাগানো শ্মশানের মড়াটাকে
যাচ্ছে না তাই, সে কোথাও।’
অঞ্জন দত্তর এই গানটির শেষ লাইনগুলি বেশ কিছু দিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ২০১৭এ মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার পর থেকে আরও পাঁচজনের মতোই মনে হল, হঠাৎ বড় হয়ে গেছি। পৃথিবীর অক্লান্ত ঘুরে চলার মধ্যে ‘চলে যাচ্ছে কত হাজার বাস, ট্রাম, ঠেলা, টেম্পো। যাচ্ছে চলে শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত। যাচ্ছে চলে সব হন্তদন্ত হয়ে, কিন্তু এতসব যাচ্ছে কোথায়?’ গানটির মধ্যে ঘুরে ফিরে এই প্রশ্নটাই আসতে থাকে এবং এমনই এক প্রশ্ন যেটা কোনও না কোনও সময় আমাদের সকলের মনে পাল তুলেছে। মাঝেমধ্যেই এই উপলব্ধিটা মনের ভিতর হানা দিচ্ছিল।
তবে হ্যাঁ, ১৯-২০ বছর বয়সে আমাদের এখানে ‘উপলব্ধি’ কথাটা শুনলে অনেকেই ভুরু কুঁচকে তাকান। বলেন যে, “জীবন দেখলে কতটুকু যে এত গুরুগম্ভীর বিষয় উপলব্ধি করতে শুরু করেছ?” এতদিন অবধি মনে হত যে ‘বয়সের থেকে বেশি পাকা’ কথাটি বোধহয় মানুষজন আমাদের মতো কমবয়সি ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে বলে থাকেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও অনেকে প্রশ্ন করেন, “তোমাকে বা তোমাদের জেনারেশনের কিছু ছেলেমেয়েকে বয়সের থেকে বেশি পাকা মনে করা হয়, এতে তোমার খারাপ লাগে না?” আগে লাগত, তবে এখন সত্যিই লাগে না।
আসলে আমাদের প্রত্যেকের মনেই সাদা-কালো খোপ কাটা ঘরে দাবার ঘুঁটি সাজানো আছে যত্ন করে। খেলার নিয়ম খুব পরিষ্কার। ঘোড়া আড়াই চালে চলবে। বোড়ের দৌড় এক পা, মন্ত্রী যে দিকে খুশি যেতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু ওই বাঁধাধরা হিসাবের বাইরে গিয়ে যদি কেউ চাল দিয়েছে, তাহলেই আমরা তাকে দাগিয়ে দিই ‘বয়সের থেকে বেশি পাকা’ কথাটি দিয়ে। সে ১৯ হোক বা ৫০।
যাক গে! আসল বিষয় থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। যে প্রশ্নটা দিয়ে এই লেখার সূত্রপাত, তা প্রায় ভুলতে বসেছি। ঠিক যে রকম আমরা ভুলে যাই চারপাশে ঘটে চলা বা ঘটে যাওয়া কত ঘটনা। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব। কিন্তু প্রতিবারই কারণটা পরিষ্কার হচ্ছিল না। কেন লিখব? কী নিয়ে লিখব? – ২০১৭ আর ২০১৮ আমার কাছে ইতিহাসের দু’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ সাল হয়ে থেকে যাবে। মানবজাতির কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া চেহারাটা যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কে বলেছে যে হীরক রাজার দেশে মানুষ গম্ভীর? আমি তো চারপাশে কান পাতলেই শুনতে পাই অজস্র হাসির শব্দ। টিভি, ফেসবুক খুললেই দেখতে পাই অজস্র মানুষ শুধুই হাসছেন।
একটি অর্ধমত্ত যুবক তার বন্ধুদের নিয়ে একটি গোল্ডেন লেঙ্গুরকে গাছে ঝুলিয়ে অবিশ্বাস্য ক্রোধে মারতে মারতে হেসে উঠছে খিলখিলিয়ে। আবার অন্যদিকে, একজন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর ছবি নিয়ে মিম বানিয়ে হেসে উঠছে আমাদেরই সমাজের বহু মানুষ। এক বছর আগে সেই দিনটায় এটিএম লাইনের পাশে পড়ে থাকা মৃত ব্যক্তিটিকে না দেখার ভান করে বীরের মতো নিজের লাইনে অটল থেকে যারা সেদিন টাকা তুলে বাড়ি ফিরেছিলেন, তাঁরাও হয়তো হেসেছিলেন মনে মনে। আর যাঁরা অনেক উপর থেকে আমাদের দেখছেন, যাঁদের মুখ থাকে এসইউভি বা সিডানের কালো কাঁচের পিছনে লুকানো, যাঁরা যুদ্ধের ব্যবসা চুড়োয় বসে পেট ভরাচ্ছেন মানুষের কান্না, যন্ত্রণা আর রক্ত দিয়ে, তাঁদের হাসির শব্দ তো ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের মতো বেজে চলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে।
‘নিউ ইন্ডিয়ার’ উচ্চতা এখন পাঁচশো পঁচানব্বই ফুট। ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’-র উপর থেকে তাই দেখা যায় না ভারতবর্ষে বেড়ে চলা চাষিদের আত্মহত্যা, পাঁচ বছরের শিশুর ধর্ষণ আর চল্লিশ লাখ মানুষের এক রাতের মধ্যে হারিয়ে ফেলা ‘নাগরিক’ হওয়ার যোগ্যতা এবং পরিচিতি। হ্যাপি ইনডিপেন্ডেন্স ডে আর সিনেমা শুরুর আগে জাতীয় সংগীত দিয়েও ঢাকা যাচ্ছে না ভারতবর্ষের বেড়ে চলা ‘অসহিষ্ণুতার’ আঁচ। অবশ্য এই বিষয়গুলি নিয়ে যাঁরাই কথা বলতে যান, তাঁদের ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা প্রায় গালাগালের মতো ছুঁড়ে দিয়ে বারবার প্রশ্ন করা হয়, “আপনারা অমুক সময় কোথায় ছিলেন? তখন তো প্রশ্ন তোলেননি?” একটা আগ্নেয়গিরির পেটের ভিতর বসে তাই সত্যিই গুলিয়ে যায় কোন ঘটনা ছেড়ে, কোন ঘটনা নিয়ে লিখব। কিন্তু লিখতে বসে একটা অদ্ভুত জিনিস লেখার কথা মাথায় এল। কোনও সাম্প্রতিক ঘটনা, খবর নয়। ‘ঈশপের গল্প’র মতো কোনও এক বইয়ের গল্পে পড়েছিলাম। এক রাজ্যের রাজা তাঁর প্রজাদের জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। পৌষ মাস। হাড় হিম করা শীত। যদি কোনও ব্যক্তি প্রাসাদের ঠিক উলটোদিকের পুকুরে বরফের মতো ঠান্ডা জলে গলা অবধি ডুবিয়ে সারা রাত কাটাতে পারে, তা’হলে রাজা তাঁকে একশত মোহর ইনাম দেবেন। কেউ এগিয়ে আসছেন না দেখে, এক জীর্ণ বৃদ্ধ চাষি রাজি হয় এই প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে। তাঁর দারিদ্র থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এ যেন এক সুবর্ণ সুযোগ। সারা রাত লড়াই করেন পুকুরের হাড় হিম করা জলের সঙ্গে। পরের দিন সকালে তাঁকে দেখে রাজার মন্ত্রী, সান্ত্রী সবাই বিস্মিত! এই অসাধ্য সাধনের কথা জানতে চাওয়ায় বৃদ্ধ চাষি সরল মনে উত্তর দেন, সারা রাত সে এক দৃষ্টে চেয়েছিল দূরে জ্বলতে থাকা প্রাসাদের টিমটিমে মশালটার দিকে। সেই আলোই এনে দিয়েছিল তাঁকে সেই চরম শীতের রাত পার করার শক্তি, গলা অবধি ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়েও তিনি অনুভব করেছিলেন সেই জ্বলন্ত মশালের উত্তাপ, উষ্ণতা। এই কথা শুনে মন্ত্রীমশাই তো রাগে ফেটে পড়েন। ঘোষণা করলেন যে চাষিটিকে তাঁর ইনাম থেকে বঞ্চিত করা হবে। কারণ, তিনি যেটা করেছেন, সেটা নাকি ভণ্ডামির লক্ষণ। মনে মনে আগুনের উত্তাপ অনুভব করাও নাকি নিষিদ্ধ!
এত পুরনো শিশুগল্প থেকে হঠাৎ করে আজকের সমাজের খুব স্পষ্ট একটা ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। যে গানটা দিয়ে লেখাটার শুরু, সেটায় বরং ফিরে আসি, সত্যিই ‘যাচ্ছে না এড়ানো শেষ শুয়ে পড়াটা’। যায়নি। যাবেও না। ভাবতে খারাপ লাগে যে ‘জীবন’ নামক খুবই সংক্ষিপ্ত এক যাত্রার মধ্যে মানুষ কেড়ে নিতে চায় সেই চাষির মনের ভিতরের অনুভব করা উত্তাপটিও। ২০১৯কে আমরা সবাই স্বাগত জানালাম অগণিত শবের উপর দাঁড়িয়ে। আমরা সবাই জানি যে, ২০১৯ থেকে আমাদের পৃথিবী স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে না। তবে শ্রীজাতকাকুর লেখা এবং বাবার নির্দেশিত ‘তারায় তারায়’ নাটকে অভিনয় করে বিশ্বাস করতে পেরেছি যে, সব পরিস্থিতি থেকে বেরনোর একটা দরজা আছে। সেটা নিজেদের খুঁজে বার করে নিতে হবে। মানুষ চাইলে সবই পারে, অন্তত কিছু মানুষ যদি ছাদের উপর আকাশটাকে দেখতে শুরু করে, তা হলে বদলে যেতে পারে অনেক কিছুই। ঠিক যে রকম ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, তারাভরা আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ঋত্বিকের কানে ফিসফিস করে বলে যান, ‘ছাদের উপরেই তো আকাশ, তাকিয়ে থাকো, ঠিক দেখতে পাবে।’ আপনারাও একবার তাকিয়ে দেখুন না, ঠিক দেখতে পাবেন। নতুন বছর ভাল কাটুক সবার।
The post অসহিষ্ণুতা, অসংবেদনশীলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ঋদ্ধির কণ্ঠস্বর appeared first on Sangbad Pratidin.