রিমঝিম দাশগুপ্ত: আমার ছেলে কোত্থাও যায়নি৷ আমি ওকে আগলে রেখেছি৷
Advertisement
ছোটবেলায় আবেশকে মহাভারতের গল্প পড়ে শোনাতাম৷ মনে আছে অভিমন্যুর কথা শুনে ও চোখ বড় বড় করে তাকাত৷ আজ সেই রংচটা বইটা দেখি৷ মনে হয়, আমার অভিমন্যু আবেশও যেন এক সন্ধ্যায় চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছিল৷ বেরনোর রাস্তা তার জানা ছিল না৷ নয়তো…৷ আমি মনে মনে বলি, বাবু চিন্তা কোরো না, আমিও আছি চক্রব্যূহে তোমার পাশে৷ তোমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার থেকে৷একুশটা দিন হয়ে গেল৷ কত মানুষ এসেছেন৷ আসছেন৷ কত বন্ধু৷ কাউকে ডাকিনি৷ নিজে থেকেই সকলে এসেছেন৷ বলছেন, আমরা পাশে আছি৷ স্বাগতর বন্ধুরা, আমার বন্ধুরা– সকলেই বাবুকে খুব ভালবাসত৷ ও ছোট থেকেই সকলের খুব আদরের৷
একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগে৷ সেদিন যারা সানি পার্কের ওই অনুষ্ঠানে ছিল, একবারও তো কেউ এল না আবেশের শ্রাদ্ধে৷ আবেশের বাবা মারা যাওয়ার পর ওর বন্ধু ঋষভ মাকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে৷ আর আজ যখন নিজের বন্ধু চলে গেল, একবারও এল না৷ কেন? কোনও ভয়ে? হয়তো আমার চোখের দিকে তাকাতে পারত না৷ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যারা সেদিন ওই পার্টিতে ছিল, প্রতিটা দিন তারা বিবেক দংশনে ভুগবে৷ এরা না কি বন্ধু! আমার তো যা হারানোর হারিয়ে গিয়েছে৷ বেঁচে থাকার একমাত্র উৎস আমার আবেশ চলে যাওয়ার পরে আপাতত আমি দিন গুনছি বিচারের৷ আমার বিশ্বাসই হয় না তিন ফুটের পাঁচিল টপকাতে গিয়ে আমার পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চির ছেলে পড়ে গিয়েছে৷
আমার মা খুব ভালবেসে আমার নাম রেখেছিল রিমঝিম৷ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিল রেখে৷ এখন বৃষ্টির সময়৷ কিন্তু যাকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করতাম, সে-ই তো চলে গেল৷ তেইশে জুলাইয়ের পর একটা রাতও আমি ঘুমোতে পারিনি৷ মনে হয়েছে এই বুঝি কেউ ‘মাম্মি’ বলে ডেকে উঠল৷ পিৎজা খাওয়ার বায়না করল৷ তেইশে জুলাই মাকে যখন ফোন করে বলি, মা আবেশ আর নেই, মা বিশ্বাসই করতে পারেনি৷ আমিই কি পেরেছিলাম? অনেক কষ্ট নিয়ে এই লেখাটা লিখলাম৷ লেখালেখি তো আমার পেশা নয়৷ রাতে ঘুম হয় না বলে এখন ডায়েরি লিখি৷ অনেকেই আমাদের পরিবার নিয়ে বিভিন্ন কথা বলছেন৷ ভাবছেন আমরা ছেলেকে কেমন মানুষ করেছি! সতেরো বছরের ছেলে মদ খেতে চলে গেল! আমরা কিন্তু খুব উচ্চবিত্ত নই৷ বাঙালি পরিবারের সংস্কৃতি, মর্যাদা আমরা মেনে চলি৷ যাঁরা আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করেন, আসুন না একবার আমাদের বাড়িতে৷ এই প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েই বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট খায়৷ দুর্গাপুজোয় ড্রিঙ্ক করে৷ তাই বলে কি তারা খারাপ? যাঁরা এগুলো মানতে চান না, আমি বলব তাঁরা এখনও এই প্রজন্মের সঙ্গে মিশতে পারেননি৷ সময় অনেক বদলেছে৷ আবেশের বয়সে আমার হাতে স্মার্টফোন ছিল না৷ চারপাশে এত মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল ছিল না৷
যুগ বদলাচ্ছে৷ আমার ছেলেও আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতোই৷ ছিল৷ ওর খুব বেশি বন্ধু ছিল না৷ হইচই করত না৷ ওর বাবা মারা যাওয়ার পরে আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল৷ দিদার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কোথাও বেরোত৷ কখনও একা একা বেরোলে আমাদের জিজ্ঞেস করেই যেত৷ বয়ঃসন্ধির এই সময়টায় সব মা-বাবাই তো একটু ভয়ে থাকে৷ আমরাও থাকতাম৷ সবাই বলে আমার শহরের পুলিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো৷ আমি মনে করি একদিন তারা নিশ্চয়ই সত্যিটা বের করবে৷
অনুলিখন: অভিরূপ দাস
The post যাঁরা বলছেন আবেশ খারাপ, তাঁরা এই প্রজন্মকে চেনেন? appeared first on Sangbad Pratidin.