'কোন অভিনেতার বয়স কমবে জানি না, আমার তো বাড়বে। পরিচালকদের কাছে সেটা একটা অপশন হতে পারে', বললেন ঋত্বিক চক্রবর্তী। তাঁর অভিনীত ‘পরিচয় গুপ্ত’র মুক্তি আসন্ন। তা নিয়েও কথা হল বিদিশা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে ঋত্বিক খুব একটা উৎসাহী নয়। কী মনে হয়, বলার কিছু নেই? কথা বলতে অনীহা?
আসলে আমি কথা বলার সেরকম কিছু পাই না। প্রতিটা বিষয়ে বক্তব্য রাখার মতো প্রাজ্ঞ বলে নিজেকে মনেও করি না। এটা বিনয় নয়– এত ইনফরমেশন চারিদিকে আমার কথা আলাদা করে কিছু যোগ করবে না। তাই চুপ করে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আগে অনেকবার ফোনে চেষ্টা করে আপনাকে পাইনি।
প্রত্যেক বিষয়ে কথা বলা বা এই যে বাইট প্রবণতা, অর্থাৎ পাবলিকলি বলা– সেক্ষেত্রে আমার কথা বা বাইট এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না।
ছবি: ফেসবুক
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতে সবাই হয় ট্রোল করছে, নয় উপদেশ দিচ্ছে, নয় মতামত দিচ্ছে...
হ্যাঁ, এটা একটা ট্রেন্ড ঠিকই। তবে আরেকটা জিনিস আমার মনে হয়। এই কথা বলার অভ্যাসে যদি তুমি ঢুকে যাও তাহলে সেটা এক ধরনের ট্র্যাপ। আমি সচেতনভাবে সেটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু সোশাল মিডিয়ার গ্রাসটাও বিরাট। আমি চেষ্টা করি যাতে এটার খপ্পরে না পড়তে হয়। মাঝে মাঝে ব্যর্থও হই। আসলে এই প্ল্যাটফর্মের জোরটা বিরাট, তোমাকে ক্রমাগত মনে করাবে যে, কথা বলে তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছ।
এই ‘মনে হওয়াটা’কেই আমার মতে চ্যালেঞ্জ করা দরকার।
আপনার নিজের ভাবনা, বোধ, নিজের কাজ নিয়ে গঠনমূলক ভাবনার আদান-প্রদান– সেটা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখেন এত হট্টগোলের মধ্যে?
ব্যক্তিগত পরিসরে আমার কথা, আমার ভাবনা বেঁচে আছে। আসলে সেইভাবেই বাঁচিয়ে রাখার কথা। মানবজাতির ইতিহাস সেই কথাই বলে। মানুষের মধ্যে, মানুষের কথা সেইভাবেই বেঁচে আছে যুগ যুগ ধরে। সব কথা, সর্বসাধারণের জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার একটা সক্রিয়তা আছে। এই সক্রিয়তার যে খুব গুরুত্ব আছে তা নয়। কিন্তু যেহেতু একটা জায়গা আছে, যেখানে কথা বলতে পারি, সেখানে আমি ঠিক আমার মতো করেই বলি যখন ইচ্ছে করে। কখনও বিরক্তি প্রকাশ করছি, ক্ষোভ প্রকাশ করছি, কখনও ব্যঙ্গ করছি। আমার বিপ্লবী সাজারও নেই। যখন ইচ্ছা করছে নিজের মতো করে বলছি।
‘পরিচয় গুপ্ত’ ১৫ নভেম্বর মুক্তি পেতে চলেছে। রণ রাজ একেবারে নতুন পরিচালক, রাজি হলেন কেন?
এই টিমটা পুরোটা নতুন। রাইটার, ডিরেক্টর, প্রোডিউসার এবং অভিনেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যর একটা ভূমিকা আছে। ওঁর মারফত পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ। সবাই নতুন, সবাই মিলে একটা কিছু করার চেষ্টা করছে। কাস্টিং বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, দর্শনা বণিক, জয় সেনগুপ্ত সহ অনেকেই রয়েছেন। এটা থ্রিলার। আমার চরিত্রটা অন্ধ– সেটার নিজস্ব কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। পাঁচ দশকের কলকাতার গল্প। প্রতিটা চরিত্রে থ্রিলারের উপাদান আছে– বেশ ভালো লেগেছিল।
আচ্ছা এমন কখনও হয়েছে, শুটিং ফ্লোরে বুঝতে পারছেন, পরিচালক ফোকাসড নন, কাজটা ভালো হচ্ছে না– তখন নিজের কাজেও একশো শতাংশ না দেওয়ার প্রবণতা চলে আসে– ওই ঢিলেমি বলে যেটাকে!
কাজে মন দেব না, সেটা হয় না। কিন্তু এমন পরিস্থিতি এসেছে বেশ কয়েকবার যেখানে মনে হয়েছে পরিচালক কাজটার সঙ্গে জাস্টিফাই করছে বলে মনে হচ্ছে না। আমার দেওয়া, না-দেওয়ার উপর ব্যাপারটা নির্ভর করে না। পরিচালককেই কাজের ক্ষেত্রটা তৈরি করতে হয়। সেটা না পারলে অভিনেতা হিসাবে দেওয়ার স্কোপ কমে যায়। তবে পেশাদার হিসাবে যতটা দেওয়া যায়, সেটাই চেষ্টা করি।
প্রায় দু দশক ধরে কাজ করছেন। ‘ঋত্বিক দারুণ অভিনেতা’, ‘ঋত্বিক একঘেয়ে কাজ করছে’ কিংবা ‘ঋত্বিকের বয়স হচ্ছে’ এমন নানা কথা হয় আপনাকে নিয়ে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে পেশাদার অভিনেতা হিসাবে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
খুবই কঠিন। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি খুবই ছোট। প্রয়োজনের তুলনায় কাজ কম। আমরা যারা রেগুলার কাজ করি তারা এটা অনুভব করি, আর তার বাইরে এত অভিনেতা, টেকনিশিয়ান আছেন তাঁরাও করেন। একটা সমস্যা হল, নতুন অভিনেতাকে খুঁজে বের করার ট্রেন্ড এখানে নেই।
নতুন যে কোনও কিছু খোঁজার ট্রেন্ড এখানে নেই, নতুন আইডিয়া খোঁজা বা...
এটা কেন বলে আপনার মনে হয়?
কেন আমি জানি না। তবে আমাদের ছবির ক্ষেত্রে ফর্মুলার পিছনে দৌড়তে গিয়ে হয়তো এটা হয়েছে। এখন তবু বলব, নতুন মুখ খোঁজার একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আর আমার সম্পর্কে যে কথাগুলো বললে– সেটা শোনার একটা মন থাকা দরকার। কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না। কারও বয়েস কমছে কি না বলতে পারব না, আমার তো বয়স বাড়বে (হাসি)। এবং অভিনেতা হিসাবে শরীর আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ‘টুল’। আমি সেটাকে সেইভাবেই ব্যবহার করব। সবাই বলে, আমার ‘মাস্ল’ নেই। এই মাস্লহীনতাকেই আমি ব্যবহার করেছি। পরিচালকদের কাছে এটা একটা অপশন যে আমার বয়স হচ্ছে।
তবু এতদিন ধরে কাজ করে অভিনেতা সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারটা জানতে চাই। তেমন কিছু আদৌ হয় কি?
আসলে অভিনেতাকে বাঁচানো মানে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। সবাইকেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেটাই আর কি...। আলাদা করে ওভাবে বলার কিছু নেই, নিজেকে একটা পরিসরে রাখার চেষ্টা করি এবং নিজেকে কীভাবে রাখব সেটা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা আছে। এখন চতুর্দিকে নানা ডিসট্র্যাকশন। আমরা কী কনজিউম করছি, সে ব্যাপারে এখনও সচেতন না হলে সর্বনাশ। নিশ্চিন্তে ‘Shit’ কনজিউম করার ব্যবস্থা পাকা, এবং সেটা বোঝার আগেই ইনটেক হচ্ছে। ইনফরমেশনের বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কোনটা নেব আর কোনটা নেব না সেটা ঠিক করাই আসল। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও এটা নিয়ে সচেতন করতে হবে।
‘সন্তান’ মুক্তি পাবে ডিসেম্বরে। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? উনি কি খুব ফোকাসড? সেটে কেমন?
মিঠুন চক্রবর্তীকে কাজের মধ্যে দেখা দারুণ ব্যাপার। তাঁর প্রতি একটা মুগ্ধতার ব্যাপার আছে। আর এত পোড়খাওয়া অভিনেতা, উনি যদি সেটে ফোকাসডও থাকেন তাহলে ঠিক কখন, কোনখানে উনি কতটা ফোকাসড হয়ে আছেন সেটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
অনেক অভিনেতাই সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন। এটাকে আপনি কীভাবে দ্যাখেন? শিল্পীর কি রাজনীতিতে আসা উচিত?
একটা সময়ে এটাকে আমার খুব ব্যক্তিগত মতামত বলে মনে হত। কিন্তু এখন আমার এই মুহূর্তে মনে হয় যে ফুলটাইম রাজনীতিবিদ ছাড়া, শখের রাজনীতিবিদে আমাদের রাজ্যের বিশাল ক্ষতি। পাঁচ বছর এমপি থাকার পর যদি কোনও এমপি বলে, আমি তো নতুন আমি তো অত বুঝি না। তাহলে সেই নতুনত্ব বোঝার জায়গা পলিটিক্স নয়, অন্যান্য জায়গায় অল্প নাচ শিখতে পারে। সেখানে গিয়ে দেখতে পারে সেটা বুঝছে কি, বুঝছে না। আগে মনে হত বিভিন্ন পেশার মানুষ রাজনীতিতে আসতেই পারে, এখনও মনে হয়। কিন্তু যে এসেছে তার শুধু রাজনীতিই করা উচিত। কারণ এই পেশার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ওয়েলফেয়ার জড়িয়ে, দায়-দায়িত্ব আছে। রাজনীতিতে এসে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ানো বিষয়টা ভালো লাগছে না।
‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ও তো থ্রিলার। ছবিটা কী নিয়ে?
হ্যাঁ, থ্রিলার। আমার বাড়িতে এক পুরনো বন্ধু এসে হঠাৎ করে মারা যায়। তার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে ব্যাগভর্তি ক্যাশ টাকা পাই। আমি এবং সোলাঙ্কি একজন সাধারণ দম্পতি। এবার আমরা কী করব, সেটা নিয়েই ছবি।
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর সঙ্গে তৃতীয় ছবি করে ফেললেন?
হ্যাঁ, আমি, প্রিয়াঙ্কা সরকার আর অপরাজিতা, অমিত সাহা রয়েছে। এটা নিয়ে কদিন বাদেই কথা বলব।
নিজেকে কোনও ডেডলাইন দিয়েছেন যে, এরপর আর অভিনয় করবেন না!
তেমন ডেডলাইন দিইনি। কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে অভিনয় যাতে করতে না হয় তেমন একটা কিছু ভেবেছি। মানে আমাকে রোজগার করতে হবে তাই আমি অভিনয় করব এই অবস্থায় যেন না যেতে হয়। মানে একটা বয়সের পর শরীরও তো দেবে না। তখন যেন এমন পরিস্থিতিতে না পড়তে হয় যে টাকার জন্যই কাজ করে যেতে হচ্ছে। জানি না কীভাবে সম্ভব করব। তবে চেষ্টা করছি।