সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রুশ-ইউক্রেন (Russia-Ukraine War) যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের ৭ মাসে রাশিয়ায় ৬ জন শীর্ষ শিল্পকর্তার ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ ঘটেছে। এঁরা তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পশ্চিমি মিডিয়ার কাছে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি রাশিয়া। কিন্তু কয়েকটি আশঙ্কা ঘনাচ্ছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের ৭ মাসে রাশিয়ায় ৬ জন শীর্ষ শিল্পকর্তার ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ ঘটেছে। এঁরা তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পশ্চিমি মিডিয়ার কাছে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি রাশিয়া। কিন্তু কয়েকটি আশঙ্কা ঘনাচ্ছে।
সিগারেট খেতে গিয়ে কেউ সাততলার জানলা দিয়ে পড়ে যেতে পারেন? তা-ও আবার শীতের রাশিয়ায়? যে-দেশে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা এড়াতে সাধারণত জানালাও ডবল ডোরের হয়। কিন্তু এই সেপ্টেম্বরের গোড়ায় জানালা দিয়ে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তেল কোম্পানি ‘লুকোইল’-এর চেয়ারম্যান রাভিল ম্যাগানভ। এই পর্যন্ত পড়েও যদি কোনও অস্বাভাবিকতা টের না পাওয়া যায়, তাহলে জেনে রাখা ভাল, ম্যাগানভের সংস্থা লুকোইল হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান, যারা ইউক্রেন যুদ্ধের একেবারে প্রথম দিকে, ৩ মার্চ, এই সামরিক অভিযানের নাগরিক ক্ষয়ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রকে। ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir PutinREuss) রাশিয়ায় থেকে কিনা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খোলা? একনায়কের যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার খেসারতই কি তবে দিতে হল লুকোইলের চেয়ারম্যানকে?
[আরও পড়ুন: হিন্দুপক্ষের আবেদন বৈধ, জ্ঞানবাপী মামলায় শুনানিতে সায় আদালতের]
এহেন মৃত্যু ‘কভার’ করতে গিয়ে পশ্চিমি সংবাদপত্রগুলি আবিষ্কার করেছে, ম্যাগানভ প্রথম নন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পুতিনের দেশের ৮ জন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্তার অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। কেউ কেউ সপরিবার খুন হয়েছেন, একেবারে পুত্র-কন্যা-সহ নিকেশ।
এই ৮ জন শীর্ষ শিল্পকর্তার মধ্যে ৬ জনই আবার তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তেল এবং গ্যাসের ব্যবসা রাশিয়ার সম্পদের অন্যতম উৎস। আর, পুতিনের বাকি পৃথিবীর সঙ্গে দরাদরির নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। ইউরোপের সঙ্গে ক্ষমতার দড়ি টানাটানি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় গত দুই দশক ধরে ভ্লাদিমির পুতিনের তুরুপের তাস গ্যাস এবং তেল। গত ৭ মাসে (মার্চ থেকে ধরলে) এই যে ৮ জন রুশি শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতির ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু ঘটল, এই ঘটনাকে কি ‘কাকতালীয়’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
মার্কিন টেলিভিশনের একজন সঞ্চালক চমৎকার বলেছেন– দ্বিতীয় মৃত্যু পর্যন্ত তো নিঃসন্দেহে ‘কাকতালীয়’ বলা যাচ্ছিল, তৃতীয় মৃত্যুর পর এসব শত্রুশিবিরের রটনা বলেও উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু যদি ৮ জন মারা যাওয়ার পরও একে রাশিয়ার কাকতালীয় ওয়েব সিরিজ মনে হয়, তাহলে নিজেদের ‘আইকিউ টেস্ট’ করিয়ে নেওয়া উচিত। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লৌহ যবনিকা তোলার প্রশ্নে যিনি সবচেয়ে মরিয়া প্রয়াস করেছিলেন, সেই মিখাইল গর্বাচভের মৃত্যুর অনতিদূরে দাঁড়িয়ে এখন যদি ৮ জন রুশি শীর্ষ-শিল্পকর্তার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করতে হয়, তাহলে আরও কয়েকটা বিষয় বিবেচনার মধ্যে চলে আসে।
ভ্লাদিমির পুতিনের একনায়কতন্ত্র চিনতে গেলে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-এর প্রাক্তন মস্কো করেসপনডেন্ট ক্যাথরিন বেল্টনের বিখ্যাত বই “পুতিন’স পিপ্ল”-এর সাবটাইটেল মনে রাখতে হবে। ‘হাউ দ্য কেজিবি টুক ব্যাক রাশিয়া অ্যান্ড দেন টুক অন দ্য ওয়েস্ট’। অর্থাৎ সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা ‘কেজিবি’ কীভাবে আবার রাশিয়ার দখল নিল এবং পশ্চিমকে প্রত্যাঘাত করল। যদি কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন, ‘কেজিবি’ আবার কোথায়, সে তো মিখাইল গর্বাচভ-ই বিলোপ করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাহলে জেনে রাখা ভাল, সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থার প্রাক্তন এজেন্ট পুতিন মস্কোর কুরসি দখল করার পর– সেই পুরনো ভদকাও আবার নতুন বোতলে ফিরে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ ‘কেজিবি’ আবার ফিরেছে ‘এফএসবি’ বা ‘ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস’ নামে। ক্যাথরিন বেল্টনের অনবদ্য বিশ্লেষণ যদি আমরা পুতিনের দুই দশকের শাসনকালের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তাহলে সাবেক কেজিবি-র ‘সিগনেচার টিউন’-কে হালের রাশিয়ার অনেক চিত্রনাট্যের নেপথ্যেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে খুঁজে পাব। আর, বুঝতে পারব, বর্তমান একনায়ক কাদের জোরে এই স্বৈরশাসন চালাচ্ছেন? কেন তিনি তাত্ত্বিক দিক থেকে আবার পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন?
ভ্লাদিমির পুতিন ‘সোভিয়েত মডেল’-এ ফিরতে চান বলেই বেলারুশে (সোভিয়েত ভেঙে তৈরি হওয়া রাষ্ট্র) গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে দেন না, ইউক্রেন আক্রমণ করে মস্কোর হাতে শাসনের রিমোট কন্ট্রোল রাখতে চান, ‘কেজিবি’ নতুন সংস্করণে সোভিয়েত জমানার হার্ডকভার ছেড়ে পেপারব্যাকে হাজির হয়, রাশিয়ার প্রধান বিরোধী দলের নেতা নাভাল্নির উপর নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করা হয়। এখনকার রাশিয়ার এই বাস্তবতাকে বুঝে নিতে পারলে ৮ জন শীর্ষ শিল্পকর্তার অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং কেন তা নিয়ে মস্কো কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হয় না, সেটাও আমরা বুঝতে পারব।
‘গাজপ্রোমব্যাঙ্ক’-এর প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিস্লাভ আভায়েভ এবং তাঁর স্ত্রী ও কন্যার গুলিবিদ্ধ দেহ পাওয়া যায় চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল। পরের দিন, ১৯ এপ্রিল, ‘নোভাটেক’ গ্যাস সংস্থার প্রাক্তন শীর্ষকর্তা ধনকুবের সের্গেই প্রোতোসেনয়া-র দেহ পাওয়া যায়, স্ত্রী-সন্তান সহ। বার্সেলোনার নিকটে ভূমধ্যসাগরের তীরে এক বিলাসবহুল রিসর্ট। স্পেনের পুলিশ ওই রুশ শিল্পকর্তার মৃত্যুর কিনারা না করতে পারলেও প্রোতোসেনায়ার পুত্র বলে চলেছেন, তঁার পরিবারের সবাইকে খুন করা হয়েছে। এই ব্যাপারে পশ্চিমি মিডিয়ার কোনও প্রশ্নের উত্তর রাশিয়ার তদন্তকারী সংস্থা দেয়নি। হয়তো উত্তর কোনও দিন পাওয়াও যাবে না। তাহলে কি পশ্চিমের বিশ্লেষকদের বক্তব্যই ঠিক? স্তালিনীয় প্রশাসন (Administration of Stalin) আর গুমখুনের সময়কে ভ্লাদিমির পুতিন কেজিবি-র প্রাক্তনীদের বলয় সহযোগে ফিরিয়ে এনেছেন– অন্য মোড়কে?