নির্মল ধর: স্যাফো ও চিত্রাঙ্গদা। কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে দু’জন আলাদা নারী, কিংবা দু’জন আলাদা মানুষ বলতেও পারি। স্যাফো (Sappho) জন্মেছিলেন সুদূর গ্রীসের লেসবস নামের এক ছোট্ট দ্বীপে। তিনিই প্রথম গ্রীক মহিলা কবি। তাঁর কবিতার বিষয় ছিল প্রেম, ভালবাসা। নারীর সঙ্গে নারীর প্রেম। পুরুষতান্ত্রিক গ্রীক সমাজ ও সভ্যতার বিরুদ্ধে নারীর সমকামী ভালবাসার কথাই ছিল তাঁর প্রতিবাদ। সেজন্য তাঁকে জীবনের চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। অন্যদিকে, ভারতের এক প্রত্যন্ত মণিপুরে জন্মেছিলেন চিত্রাঙ্গদা। শরীরে নারী, তাই নারীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল আজন্ম। বাবাও তাঁকে তৈরি করেছিলেন একজন পুরুষ সৈনিকের যোগ্যতায়। কিন্তু মনেপ্রাণে তিনি নারী এবং নারীর প্রতিই তাঁর প্রেম ও শরীরী আকর্ষণ, এজন্য কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। অর্জুনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে তিনি রাজি নন। কিন্তু বাবা চিত্রবাহণ রাজনৈতিক সুবিধা পাবার জন্য অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দেবেনই। কী তার পরিণতি, সেটাও আমরা জানি। সে বিয়ে সুখের হয়নি। একমাত্র সন্তান বভ্রুবাহন কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।
চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) নৃত্যনাট্য লিখেছিলেন। এবার বিশ্বের দুই প্রান্তের দুই প্রতিবাদী নারীকে নিয়ে এক অন্য ঘরানার নাটক ‘স্যাফো চিত্রাঙ্গদা’ (Sappho Chitrangadaa) লিখে সেটি প্রযোজনা করল দমদম শব্দমুগ্ধ দল, যার কর্ণধার রাকেশ ঘোষ। তাঁরই কলমে স্যাফো ও চিত্রাঙ্গদা শুধু নন, সমান্তরাল ভাবে উঠে এসেছে আজকের রাজনীতির জটিল পরিস্থিতি, নারীর সামাজিক অবস্থান এবং প্রতিবাদের কথাও। রবীন্দ্রনাথের মদন চরিত্রকে স্যাফো এবং চিত্রাঙ্গদা চরিত্রের মাঝখানে নিয়ে এসেছেন রাকেশ। দুই প্রান্তিক সময়ের দু’জন তথাকথিত সমাজবিরোধী মানুষ কাছাকাছি আসতে চায়, আসেও। এই কাজে মদন দৌত্যের কাজ করে। মদন নিজেও যৌনতার পরিচয়ে একজন বাই-সেক্স্যুয়াল যায়। দ্রৌপদীর সঙ্গে বনবাসী অর্জুনের বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর চিত্রবাহণ মদনকেই দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর দায়িত্ব দেয়।
[আরও পড়ুন: সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাচ্ছেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক শংকর!]
আর এখানেই নাট্যকার ও পরিচালক সুন্দরভাবে সেই যুগের কূটনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দেন আজকের সময়ের নোংরা রাজনীতির দিকটা। নাটকের পরিণতির চাইতেও প্রযোজনায় প্রকট হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের দু’টি মানুষের জীবন ভাবনা, তাঁদের একান্ত যৌনজীবনের স্বাধীনতার কথাগুলো। স্যাফোর কবিতা তৎকালীন সময়ে পুরুষ সমাজ মেনে নিতে পারেনি, অশালীন আখ্যা দিয়েছে তাঁর নিজস্বভাবে যাপিত জীবনকে। চিত্রাঙ্গদার স্বাধীনতা সঙ্গী পছন্দ করতে পারেননি। অর্জুনের ক্ষমতার কাছে বাবার আদেশে মাথা নিচু করতে হয়েছে তাঁকে। মদনের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সে একদিকে দূত, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি। পরম্পরায় সেই একই কাজ করে চলেছিল বসন্তও। রাজ অনুগ্রহের প্রতীক স্বরূপ হারের টুকরো মুখে নিয়ে তাকেও মদনের জুতোয় পা গলাতেই হল। রাজনীতির এই ধারাবাহিকতার পর্বটি সূক্ষ্ম ইশারায় সুন্দর বুঝিয়ে দেন নির্দেশক।
দমদম শবদমুগ্ধের এই নতুন প্রযোজনা বক্তব্যে যত জটিল এবং সমসাময়িক, উপস্থাপনায় ঠিক ততটাই বর্ণময়, উজ্জ্বল, কখনও কখনও একটু বেশিই যেন। পোশাক পরিকল্পনায়, আলোর ব্যবহারে, এমনকী উপকরণের পরিকল্পনাতেই গভীর বুদ্ধির পরিচয় রয়েছে। বিশেষ করে সৈনিকদের হতে অস্ত্র হিসেবে পদ্ম ও বর্ষার ফলা ব্যবহার, চিত্রাঙ্গদা ও স্যফোর পোশাকের রং তাদের চরিত্রের অন্তরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে। নির্দেশনার কাজে রাকেশ বক্তব্যে জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থাপনার প্রতি জোরাল নজর দিয়েছেন। বেশ সুসংবদ্ধ প্রযোজনা। শুধু একটু নাটকীয় অভিনয়কে টোনড ডাউন করলে ভাল হয়। ছোট, বড় সব চরিত্রের শিল্পীরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভূমিকায় সমান সুরে তালে কাজ করেছেন। প্রধান তিন চরিত্র স্যাফো(কৃষ্ণা রায়), চিত্রাঙ্গদা (লোপামুদ্রা গুহ নিয়োগী) এবং মদন(রঞ্জন বসু), তিনজনই যেন একে অপরকে সাপ্লিমেন্ট করেছেন সারাক্ষণ। সকলের সম্মিলিত অভিনয় এই প্রযোজনার বড় দিক। স্যাফো শুধু সমকামীদের প্রতিনিধি নন, তিনিও যে একজন বড় মাপের কবিও। তাঁর কবিতার সাঙ্গিতিক ব্যবহার সত্যিই নাটকটিকে বড়ো উপভোগ্য করে তোলে। আর সাম্প্রতিক রাজনীতির চাদরে মুড়ে রাখায় ‘স্যাফো চিত্রাঙ্গদা’ হয়ে ওঠে আজকের নাটকও।