বিশ্বদীপ দে: জল যে নাকের উপরে উঠে পড়েছে তা নতুন কথা নয়। বিশ্ব উষ্ণায়নের গনগনে প্রভাবে চোখের নিমেষে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। যার ধাক্কায় পরিবেশগত বিপর্যয়ও কম ঘটছে না। মেরুদেশে গলছে বরফ। আমাদের হিমালয়ের হিমবাহগুলোও আর নিরাপদ নেই। সব মিলিয়ে যেন এক নিশ্চিত বিকট হাঁমুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা। আর এর জন্য দায়ী যে প্রাণীটি তার নাম যে মানুষ, একথাও কোনও নতুন কথা নয়। নিজেদের দায়িত্বে পৃথিবীকে দাউদাউ জ্বালিয়ে অন্য জীবদের জন্যও 'শেষের সেদিন ভয়ংকর' নিয়ে আসছে 'প্রখর বুদ্ধিমান' হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স। অথচ সাবধান হওয়ার জন্য বিস্তর সময় মিলেছিল। গাই ক্যালেন্ডার নামের এক বিজ্ঞানী প্রথম এব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছিলেন। সেটা ১৯৩৮ সাল। অর্থাৎ ৮৬ বছর আগে। কিন্তু মানুষ কি সেকথায় কান দিয়েছে?
ইতিহাস ঘাঁটলে আরও পিছন দিকে যাওয়া যেতে পারে। সেটা ১৮৯৬ সাল। সুইডেনের নোবেলজয়ী রসায়নবিদ সভান্তে আরিয়েনিয়াস প্রথম বলেছিলেন, বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড যত মিশতে থাকবে ততই সম্ভবত উষ্ণ হতে থাকবে পৃথিবী। কিন্তু এমন সম্ভাবনার গুঞ্জনে সেই সময় কেউ কান দিতে রাজি ছিল না। আসলে তখনও পরিবেশের এমন গনগনে অবস্থা কল্পনার বাইরে। দূষণও অনেকটাই কম। ফলে মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাস দৃঢ় ছিল, প্রকৃতি বিপুল শক্তিশালী। মানুষের সাধ্য নেই তাকে প্রভাবিত করার।
[আরও পড়ুন: তীব্র যন্ত্রণায় কাতর, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নীতীশ কুমার]
কিন্তু গাই ক্যালেন্ডার যখন বিশ্ব উষ্ণায়নের কথা বললেন, তখন আর বিষয়টা উপেক্ষা করার মতো জায়গায় থাকল না। কেননা স্বল্প পরিচিত শখের এই বিজ্ঞানী পেশায় স্টিম ইঞ্জিনিয়ার নিছক কোনও সম্ভাবনার কথা বলেননি। তিনি রীতিমতো হিসেব কষে দেখালেন, গত ৫০ বছরে একটু একটু করে বেড়েছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। সারা বিশ্বের ১৪৭টি ওয়েদার স্টেশন থেকে রেকর্ড সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এবং সমস্ত তথ্য একত্রিত করে ক্যালেন্ডার জানিয়ে দিলেন, অর্ধ শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কিন্তু এবারও বিষয়টাকে আমল দিতে রাজি হলেন না বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা। তাঁরা নাক-টাক চুলকে বললেন, নাহ! শিল্পের কারণে কারখানা থেকে বেশি করে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে এসব মেনে নেওয়ার কোনও মানে নেই। মানুষের কি এমন সাধ্য রয়েছে যে প্রকৃতিকে টেক্কা দেবে! পরের বছর, ১৯৩৯ সালে লেগে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গোটা পৃথিবী সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল বোমা, সাইরেন, গোলাগুলি, মারণযজ্ঞের বিষাক্ত নিশ্বাসের সামনে। স্বাভাবিক ভাবেই 'তুচ্ছ' গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কে আর মাথা ঘামাবে! এদিকে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে নতুন করে যেন জোয়ার এল শিল্পে। বাড়তে লাগল উৎপাদন।
[আরও পড়ুন: ভোট মিটতেই সম্মুখ সমরে! জলসংকটে কেজরি সরকারের বিরুদ্ধে কলসি ভেঙে বিক্ষোভ কংগ্রেসের]
১৯৫৮ সালে তরুণ এক ভূ-রসায়নবিদ চার্লস ডেভিড ফের মুখ খুললেন এই নিয়ে। তথ্য পেশ করে দেখালেন কীভাবে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। জল ও বায়ুতে বিষবায়ু কীভাবে ঢুকে পড়ে সাড়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে পরিবেশের। এর আগে কেউই এমন কোনও গবেষণা করেনি। ছয় দশক আগে সুইডেনের নোবেলজয়ী যে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন, তা যে অমূলক ছিল না তা প্রমাণ হয়ে গেল হাতেকলমে। কিন্তু সেও তো এক অদ্ভুত সময়। রাশিয়া-আমেরিকার ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। হিরোসিমা-নাগাসাকির অতীত খুব পুরনো নয়। ১৯৫১ সালে মানুষের হাতে এসে গিয়েছে হাইড্রোজেন বোমাও! ফলে যে কোনও সময় যে কোনও স্থানেই আছড়ে পড়তে পারে পারমাণবিক বা অন্য কোনও ধরনের বিপজ্জনক মারণাস্ত্র। মুহূর্তে গুঁড়িয়ে যেতে পারে আস্ত শহর। এমন ভয়ংকর সম্ভাবনার মধ্যে পৃথিবীর 'জ্বর' নিয়ে কে আর ভাবে!
এর মাঝে গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় আবার কেউ কেউ বলতে লাগলেন, পৃথিবী মোটেই গরম হয়ে উঠছে না। বরং আর একটা তুষারযুগ নেমে আসার অপেক্ষা। কিন্তু ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানীরা তৈরি করে ফেললেন পৃথিবীর জলবায়ুর প্রথম কম্পিউটার মডেল। সেখানে বলা হল বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড মেশার পরিমাণ দ্বিগুণ হলে তা পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিতে পারে। এই প্রথম সেই অর্থে নড়েচড়ে বসলেন বহু পরিবেশবিদ। পরের বছর ১৯৬৮ সালে কলম্বাসের ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির গ্লেসিওলজিস্ট ড. জন মার্সার সকলকে সতর্ক করলেন। বললেন, এভাবে যদি বিশ্ব উষ্ণায়ন চলতে থাকে তাহলে একদিন মেরুপ্রদেশের বরফ গলবেই। আর তার ফলে সমুদ্রের জল ফুলেফেঁপে ডেকে আনবে প্রলয়! পরের দশকেও দেখা গেল পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে! ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞানীদের গবেষণাপত্রে প্রথমবার উচ্চারিত হল একটা নাম। গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বিশ্ব উষ্ণায়ন।
১৯৮৮ সালকে সেই সময়ের নিরিখে সাম্প্রতিক সময়কালের সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বলতে গেলে সেই সময় থেকেই গোটা পৃথিবীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ উদ্বিগ্ন হলেন বিষয়টা নিয়ে। মার্গারেট থ্যাচারের মতো রাষ্ট্রনেতারা সরব হলেন 'পৃথিবীর জ্বর' নিয়ে। কিন্তু পরবর্তী দশকগুলিতে যতই সচেতনতার প্রচার হোক, ফল যে কিছু মেলেনি তা বুঝে নিতে একেবারে হাল আমলে ফেরা যাক। বছরের নিরিখে উষ্ণতম হিসাবে রেকর্ড গড়েছে ২০২৩। রাষ্ট্রসংঘের (UN) এক রিপোর্টে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০২৩- এই দশ বছর পৃথিবীর বুকে সর্বকালের সবচেয়ে উষ্ণ দশক ( Hottest Decade)! এই নয়া রিপোর্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের মন্তব্য, ‘‘খাদের কিনারে পৃথিবী।’’
২০২৩ সালে তাপমাত্রার নানা রেকর্ড গড়েছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা। পাশাপাশি চিন ও আরও বহু দেশই নাভিশ্বাস ফেলেছে দাবদাহে। দীর্ঘ সময় খরাক্লিষ্ট থেকেছে আফ্রিকা। কানাডা সাক্ষী হয়েছে ভয়ংকর দাবানলের। এই পরিস্থিতিতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে পৃথিবীর ‘নিয়ার সারফেস টেম্পারেচার’ অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ ফুট উপরের তাপমাত্রা। যা এখন ১.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস! ‘বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা’র প্রধান অ্যান্ড্রেসা সেলেস্টে সাউলোর মতে এহেন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টকে ‘পৃথিবীর জন্য লাল সতর্কতা’ হিসেবে দেখা উচিত।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবানল সবই বাড়ছে। আগামিদিন যে আরও কতটা ভয়ংকর হতে চলেছে তা সত্যিই বলা মুশকিল। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করলেও জল নাকের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এভাবে চললে বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপটে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। উপকূলের তটসীমা বদলে যাবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বহু প্রজাতির প্রাণী। আর মানুষ? নীল রঙের গ্রহটাকে ক্রমশ খাদের কিনারে ঠেলে নিয়ে গিয়ে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারব আমরা? পৃথিবী পুড়ছে। ফিরে শুলে দহনজ্বালা কমবে না। গরিষ্ঠ সংখ্যক মর্ত্যবাসী একথা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন ততই যে মঙ্গল, তা গবেষক না হয়েও বোধহয় বলে ফেলা যায়।