সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সদ্য নেমে এসেছে মুন রকেট। কিন্তু দরজা খোলেনি। দাঁড়িয়ে রয়েছে থম মেরে। দ্রুত বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কাটা হল দরজা। কিন্তু ভিতরে যে কোনও শব্দ নেই! অকস্মাৎ দেখা যায় ভিতরে থাকা মানুষগুলি নিঃসারে পড়ে আছে। যদিও পরে দেখা গেল সকলেই বেঁচে রয়েছেন। কমিক্সপ্রেমী মাত্রই জানেন, এই মানুষগুলি কারা। টিনটিন, প্রফেসর ক্যালকুলাস, ক্যাপ্টেন হ্যাডক... পাঠকদের খামোখা টেনশনে ফেলে দিয়েছিলেন স্রষ্টা অ্যার্জে সাহেব। শেষের মধুরেণ সমাপয়েৎ তাই আরও জমজমাট মনে হয়। কিন্তু এটা তো নেহাতই বানানো গপ্পো। বাস্তবের পৃথিবীতে এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল গত শতকের সাতের দশকের শুরুতে। সয়ুজ ১১ মহাকাশযান নেমে এসেছিল পৃথিবীতে। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখা গেল ভিতরে থাকা সকলেই মৃত!
মহাকাশ অভিযান মানেই অজানার খোঁজ তো বটেই। সেই সঙ্গেই এক সম্পূর্ণ অচেনা দুনিয়ায় অবগাহন। সেই পাঁচের দশক থেকে একটু একটু করে যার সূত্রপাত। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সোভিয়েত নভশ্চর ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে গেলেন। তিনিই এই গ্রহের প্রথম মানুষ যিনি এই কীর্তি গড়লেন। কে ভাবতে পেরেছিল পরবর্তী আট বছরেই চাঁদের মাটিতেও পা রাখবে মানুষ! সে এক আশ্চর্য সময়! 'নিখিলের সংগীতের স্বাদ' সভ্যতাকে এক নতুন শক্তিতে তেজিয়ান করে তুলল। জল-স্থলের পর অন্তরীক্ষেও মানুষের জয়গাথা রচিত হতে লাগল। কিন্তু এই গতিই রুদ্ধ হল ১৯৭১ সালের ৩০ জুন। মহাকাশে প্রথমবার মৃত্যু হল নভোচারীদের। এখনও পর্যন্ত এটাই অনন্ত শূন্যে মৃত্যুর একমাত্র নজির। এই বিষাদঘন ঘটনা এরপর বদলে দিয়েছিল নভশ্চরদের পোশাকও।
১৯৭১ সালের ৬ জুন। মহাকাশে পাড়ি দিল সোভিয়েত ইউনিয়নের (আজকের রাশিয়া) মহাকাশযান সয়ুজ ১১। ভিতরে ছিলেন তিন নভশ্চর জর্জি ডব্রোভলস্কি, ভ্লাদিস্লাভ ভলকোভ ও ভিক্টর পাতসায়েভ। মহাকাশে ২৩ দিন ছিলেন তাঁরা। এই দীর্ঘ সময় বিশ্বের প্রথম মহাকাশ স্টেশন সালয়ুত ১-এ যুগান্তকারী নানা গবেষণা চালান তাঁরা। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকার বিষয়টিও ছিল এই অভিযানের অন্যতম প্রধান বিষয়।
ক্রমে এগিয়ে এল ফেরার দিন। ৩০ জুন। সয়ুজ ১১ ফিরে এল পৃথিবীতে। অবশ্য আগেই সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফলে উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়ছিল। কাজাখস্তানে দাঁড়িয়ে থাকা মহাকাশযানটির সামনে উপস্থিত হন উদ্ধারকারী দল। কিন্তু হ্যাচ খুলতেই থ হয়ে যায় দলটি! দেখা যায় যানটির ভিতরে মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তিন নভশ্চর! শোকের ছায়া নেমে আসে গোটা পৃথিবীতেই। ইউরি গ্যাগারিন থেকে ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা কিংবা আর্মস্ট্রং- একের পর এক নভশ্চরের সফলতা সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে তুলছিল। সেখানে সয়ুজ ১১-এর ঘটনায় আচমকাই নেমে আসে বিষাদস্রোত। ক্রেমলিন ওয়ালের নেক্রোপলিসে সমাহিত করা হয় তাঁদের।
কিন্তু কেন প্রাণ হারাতে হয়েছিল ওই তিন নভশ্চরকে? দেখা যায় তাঁদের ত্বকে নীলচে রঙের ছোঁয়া। কান থেকে রক্তপাতের চিহ্নও রয়েছে। পরিষ্কার হয়ে যায়, বায়ুর চাপের তারতম্যই তাঁদের মৃত্যুর কারণ। আসলে পৃথিবী থেকে ১৬৮ কিলোমিটার উপরে থাকা অবস্থায় মহাকাশযানটির ডিসেন্ট ক্যাপসুল থেকে মডিউল বিচ্ছিন্ন করার সময় আচমকাই চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত একটি ভালভ খুলে যায়। আর তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি। মাত্র ৬০ সেকেন্ডের মধ্যেই যানের ভিতরে অক্সিজেন অপ্রতুল হয়ে ওঠে। তিন মহাকাশচারী চেষ্টাও করেছিলেন ভালভটিতে বন্ধ করার। কিন্তু সফল হননি। হাতে সময় ছিল অত্যন্ত অল্প। প্রবল চাপের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাঁরা। প্রিয় এই নীল গ্রহ থেকে তখন তাঁরা অনেকটাই দূরে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশাসন অবশ্য প্রথমে এই মৃত্যুর খবর প্রচার করেনি। বরং ২৩ দিনের মিশন নিয়েই প্রচার চলছিল। ক্রমে সবটা প্রকাশ্যে আসে। এই ঘটনা কেবল রুশ মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে জড়িতদেরই নয়, সারা পৃথিবীর মহাকাশ গবেষণাকেই প্রভাবিত করেছিল। সেই থেকেই উৎক্ষেপণ ও অবতরণের সময় মহাকাশচারীদের প্রেশার স্যুট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি 'ভিলেন' ভালভকে চিহ্নিত করে বদলে ফেলা হয় যানের নকশা। লক্ষ্য একটাই ছিল, ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে। এখনও পর্যন্ত অবশ্য তা ঘটেনি। বলা চলে জর্জি ডব্রোভলস্কি, ভ্লাদিস্লাভ ভলকোভ ও ভিক্টর পাতসায়েভরা যেন নিজেদের প্রাণ দিয়ে সকলকে সতর্ক করে গেলেন!
এই লেখার পরিশিষ্টে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারীর কথা বলতেই হচ্ছে। তিনি সুনীতা উইলিয়ামস। তিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন ৮ দিনের জন্য। যে যানে ফেরার কথা সেটা গেল বিগড়ে। তারপর থেকে ক্রমেই দীর্ঘ হয়েছে প্রতীক্ষা। কবে ফিরবেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সোশাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যম, সর্বত্রই একটা টেনশনের স্রোত। মনে পড়বে কল্পনা চাওলাকেও। শেষপর্যন্ত পৃথিবীতে ফেরা হয়নি তাঁর। ফিরেছিল ঝলসে, কুঁকড়ে যাওয়া দেহাবয়বের ঝাপসা প্রতিবিম্ব মাত্র। একই সঙ্গে মনে পড়ে রুশ নভোচর সের্গেই ক্রিকালেভ। ১৯৯১ সালে তাঁকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় তিনি অন্তরীক্ষেই। সোভিয়েত ভেঙে ১৫টি দেশ হল। দেশ হারালেন ক্রিকালেভ। কে ফেরাবে তাঁকে? এই সংশয় ক্রমেই দীর্ঘ করল বন্দিদশা। মাসের পর মাস ভাঙা শরীর-মনে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। ৩১১ দিন পরে ফিরতে পেরেছিলেন। কিন্তু ক্রিকালেভ-সুনীতাদের মতো সৌভাগ্য হয়নি ডব্রোভলস্কিদের। যা আজও এক বিষাদগাথা হয়ে রয়ে গিয়েছে।
