বিশ্বদীপ দে: শহরের মাঝখানে বসানো ছিল এক রাজপুত্রের স্ট্যাচু। একদিন রাতে সেই শহরে হাজির হয়েছিল ছোট্ট এক পাখি। তার সঙ্গীরা দল বেঁধে মিশরে চলে গেলেও সে একলাই নেমে এসেছিল সুখী রাজপুত্রের মূর্তির কাঁধে। একশো বছরেরও বহু বছর আগে অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা 'হ্যাপি প্রিন্স' আজও সারা বিশ্বের ছোটদের উদ্বেলিত করে। আর এই অবিস্মরণীয় কাহিনিকে নিয়ে কথা বলতে গেলে কখনওই বাদ দেওয়া যাবে না সেই সোয়ালো পাখিটিকে। আদপে যে ছিল পরিযায়ী। গ্রীষ্মের খোঁজে মিশরে যেতে না পেরে ভাগ্যের ফেরে যাকে নামতে হয়েছিল গল্পে বর্ণিত শহরে। তবে সে মাঝপথে থেমে গেলেও প্রতি বছর হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে সাইবেরিয়ার সুদূর কোণ থেকে এদেশে হাজির হয়ে যায় পরিযায়ী পাখিরা! আজও বিস্মিত করে তাদের এই পথ চলা। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে একেবারে ঘড়ি ধরে কী করে হাজির হয় তারা? কেমন করে চেনে পথ?
বর্ষা ও শরৎ পেরিয়ে হাজির হয় হেমন্ত। শীত আসার আগে খুব স্বল্প সময়ের জন্যই সে চেনা দিয়ে যায় আজকাল। বেলা ছোট হয়ে আসা, চামড়ায় টান ধরা এই ঋতুতেই এই শহরে উপস্থিত হয় পরিযায়ী পাখিরা। সাইবেরিয়া বা রাশিয়া থেকে আসে ওয়েডার্স ও ডাক। ইউরোপ থেকে আসে ইউরোপিয়ান ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার, বার্ন সোয়ালের মতো আরও কত সব পাখি! খাবারের অভাব কিংবা প্রজননের সমস্যার মতো নানা কারণেই তাদের এই 'অনন্ত' সফর। তবে আসল কারণ বোধহয় উষ্ণতা। এই সময়ে আসা। আর মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ফিরে যাওয়া। এটাই তাদের সারা বছরের রুটিন।
পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে উনিশ শতাংশই পরিযায়ী। কীভাবে যে এরা একেবারে নির্ভুল ভাবে দিক চিনতে পারে তা আজও পুরোপুরি ধরতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। আর যাই হোক, তারা তো আর গুগল ম্যাপ ব্যবহার করতে পারে না! আসলে তাদের পথ দেখায় চিরকালীন 'গুগল ম্যাপ'। আকাশে ভেসে থাকা সূর্য-তারা। মূলত সূর্যের সঙ্গে দিগন্ত বরাবর রেখা ধরে দিকচিহ্ন তৈরি করে ফেলে পরিযায়ী পাখিরা। একই ভাবে রাতের আকাশে তারাদের অবস্থানও দিব্যি চিনে রাখতে পারে পাখিরা।
এখানেই শেষ নয়। তাদের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ 'টুল' হল পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র। মনে করা হয় পাখিরা তাদের ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের সাহায্যে এটাকে কাজে লাগিয়ে চিনে নেয় গতিপথ। কোনও কোনও বিজ্ঞানী মনে করেন, পাখিদের চোখের 'কোয়ান্টাম এফেক্টস' তাদের সাহায্য করে চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলিকে চিনে নিতে।
এছাড়াও পাখিরা মানুষের মতোই 'ল্যান্ডমার্ক' তৈরি করে রাখে মনে মনে। হয়তো পুকুর কিংবা গাছ ইত্যাদি দেখে দেখে তারা পথ চলে। পরের বার অথবা ফেরার সময় সেই সব পথচিহ্ন তাদের বুঝিয়ে দেয় ঠিক পথেই চলেছে তারা। এর পাশাপাশি পাখিদের আর এক ভরসার জায়গা হল গন্ধ। হ্যাঁ, গন্ধের স্মৃতিকেও কাজে লাগিয়ে পথ চিনে রাখতে পারে পাখিরা।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য নিশ্চিত, এছাড়াও আরও কিছু থাকতে পারে যা এখনও মানুষের জানা নেই। এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হওয়া মানেই তারা পাখিদের মনের সব খবর রাখবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সব মিলিয়ে এই প্রক্রিয়া মানুষকে বিস্মিতই করে। এইভাবে পথ চিনে প্রতি বছর একই পথে যাওয়া আসার সময় খাবার দাবার, ওই সব এলাকার উষ্ণতা সবই মাপতে পারে তারা। কেবল বড় বড় পাখিরাও নয়, ছোট পাখিরাও কী অনায়াসেই পথ চিনে দীর্ঘ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। পথে ঠিক জোগাড় করে দেয় বেঁচে থাকার খুঁদকুড়ো। আপাত ভাবে মনে হবে এ আর এমন কী! কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবতে গেলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
পরিযায়ী এই পাখির দল দেশের অন্য অংশের মতোই এই বাংলাতেও আসে। যার মধ্যে সুন্দরবনের ঐতিহ্য তো সর্বজনবিদিত। এখানকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বার-হেডেড গুজ, রেড-নেকেড গুজ, পিলগ্রিমের মতো বহু প্রজাতির পাখির প্রিয় আশ্রয়স্থল। এরই পাশাপাশি বর্ধমানের বকুলপুর কিংবা জলপাইগুড়ির বহু এলাকায় সাময়িক বাসা বাঁধে পরিযায়ীরা। তালিকায় অবশ্যই রয়েছে কলকাতাও। সাঁতরাগাছি হোক কিংবা কাঁকুড়গাছি অথবা চিড়িয়াখানা- সারি বেঁধে পাখির দল নেমে আসে আশ্রয়ের খোঁজে।
কিন্তু এও সত্যি, ক্রমেই যেন কমছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা। কারণটা ভাবতে বসলে বোধহয় সকলেই অনুমান করতে পারেন। একাধারে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা কিংবা গাছ কাটার মতো কাজ করে মানুষ কেবল নিজেদেরই নয়, এদের সকলেরই বিপদ বাড়াচ্ছে। এদিকে জলবায়ুর পরিবর্তন অর্থাৎ তাপমাত্রা বাড়তে থাকা কিংবা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিপদে পড়ছে পরিযায়ী পাখিরা। তাছাড়া নগরায়ন কিংবা দূষণের মতো বিপদও তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে মানুষের 'বদভ্যাসে' যতই রং হারাচ্ছে সভ্যতা, ততই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে একটু উষ্ণতার খোঁজে পরিযায়ী পাখিদের পাড়ি দেওয়া যেন কঠিন হয়ে পড়ছে। তবু... আজও ওরা আসে। বিষণ্ণ হেমন্তের আলোছায়াকে রঙে রঙে রঙিন করে তুলতে আকাশের বুক চিরে আসে বহু দূরের অতিথিরা। মানুষকে বুঝিয়ে দেয় অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা যতই কঠিন হোক, তা অসম্ভব নয়। আজও।