রিচার্ড পার্কার। সাড়ে চারশো পাউন্ড ওজনের এই বাঘই ছিল 'লাইফ অফ পাই' উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। পাই নামের এক তরুণকে বেঁচে থাকা এবং প্রবল দুর্যোগের মধ্যেও জীবনীশক্তি না হারিয়ে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছিল সে। ইয়ান মার্টেলের উপন্যাসে বাঘ এক বিপুল মানসিক ও শারীরিক ক্ষিপ্রতার প্রতীক। আমাদের বাস্তব পৃথিবীতেও কিন্তু বাঘ এক অমোঘ প্রতীক। যে ভালো থাকলে 'সুস্থ' থাকে অরণ্যও। অথচ গত দু'বছরেরও কম সময়ে এদেশে মৃত্যু হয়েছে প্রায় আড়াইশো বাঘের। এই পরিসংখ্যানে উগ্বিগ্ন ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা। কেননা বাঘ কেবল একটি পশুমাত্র নয়। তার বিপন্নতা যেন মানুষের প্রকৃতির প্রতি অবহেলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল এই বিষয়েই যোগাযোগ করেছিল ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডুর সঙ্গে। শুনলেন বিশ্বদীপ দে।
নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলতে নারাজ জয়দীপবাবু। বরং নিজেকে বাঘ সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কর্মী বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁর মতে, বাঘের মৃত্যুর নেপথ্যে চোরাশিকারীরা যেমন রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে অন্য বিপদও। জঙ্গলই হারিয়ে যাচ্ছে বাঘের থেকে! আর সেটাও তার টিকে থাকার ক্ষেত্রে এক প্রবল প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে। জয়দীপবাবুর কথায়, ''গোটা ভারত জুড়েই দাপাচ্ছে কনজিউমারিজম। আর সেই চাহিদা পূরণ করতেই জঙ্গল ছোট হচ্ছে! আমরা একে বলি মাইন্ডলেস ডেভেলপমেন্ট। জঙ্গল কেটে হাইওয়ে তৈরি করা হচ্ছে, হাইওয়ে সম্প্রসারিত করা হচ্ছে... আবার নতুন করে রেললাইন পাতা হচ্ছে। কোথাও কোথাও খননকার্য চলছে। বিভিন্ন জায়গায় নানা নির্মাণের কাজ চলছে। এর ফল ভুগতে হচ্ছে জঙ্গলকে।''
২০২৪ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১২৫টি বাঘের। আর এবছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১১৭ জনের। অর্থাৎ ২০২৪ থেকে ধরলে মৃত বাঘের সংখ্যা ২৪২! বছর শেষের আগে তা আরও বেড়ে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা। ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথোরিটি’ তথা NTCA-র তথ্য থেকে এমনটাই জানা যাচ্ছে। জয়দীপবাবুর মতে, ''সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। বহু রাজ্য বাঘের মৃত্যুর রিপোর্টিং ঠিক করে করে না, নিজেরা কৃতিত্ব নেবে বলে। ফলে সেই সংখ্যাটা এন্ট্রি হচ্ছে না।''
ফাইল ছবি
কিন্তু কেন এত বেশি বাঘের মৃত্যু হচ্ছে? তিনি জানাচ্ছেন, 'প্রোটেকশন, আইসোলেশন অ্যান্ড স্পেস' এটাই বাঘের বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। এই তিনটির মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই বিপদ। অথচ সেটাই হচ্ছে। এই বিপণ্ণতা কিন্তু স্রেফ বাঘের নয়। জয়দীপবাবু বলছেন, ''যে জঙ্গলে বাঘ থাকে সেই জঙ্গলে লক্ষ্মীশ্রী থাকে। বাঘকে কেন্দ্র করেই সেই জঙ্গলের সব জন্তুজানোয়ার বেঁচে থাকে। আমরা হিন্দিতে একটা কথা বলি। শের বাঁচানা বাহানা হ্যায়, আসলি মে জঙ্গলকো বাঁচানো হ্যায়। ভারতে ৫৩টি টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট আছে। এর দৌলতে ২১ হাজার ৩৩৬ কিলোমিটার নদীস্রোতকে তারা 'প্রাণ' জুগিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ করুন ৩৩ হাজার কিলোমিটার নালা। সুতরাং যদি জঙ্গলই বিপণ্ণ হতে থাকে, তাহলে তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল পড়তে বাধ্য হচ্ছে। আসলে বাঘ হচ্ছে একটা ইন্ডিকেটর স্পিসিস। বাঘের জঙ্গল কমছে মানেই বিপদ বাড়ছে।''
এই পরিস্থিতির জন্য মানুষের সহনশীলতার অভাব বলেই ধরছেন জয়দীপবাবু। তিনি বলছেন, ''আজকাল তো মানুষ নিজের ঘরে টিকটিকি দেখতে পেলেও মেরে ফেলছে। অর্থাৎ সামগ্রিক একটা প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে অসহিষ্ণুতার। সেটাই বাঘের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।'' আরেকটা বিষয় হল বাফার অঞ্চল তৈরি হয়ে যাওয়া। উদাহরণ দিতে গিয়ে জয়দীপবাবু বলছেন, ''করবেটের সঙ্গে রাজাজি বলে একটা জঙ্গল আগে যুক্ত ছিল। ফলে বাঘেরা দুই অঞ্চলেই ঘুরে বেড়াতে পারত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাঝখানে জনবসতি তৈরি হওয়ায় বাফার অঞ্চল তৈরি হয়েছে। ফলে দুই অঞ্চলের বাঘেরা সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।'' সব মিলিয়ে বিপদ বাড়ছে। অবিলম্বে সতর্ক হওয়া দরকার। জয়দীপবাবুর মতো গোটা দেশে যে ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা এই নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা সকলেই চাইছেন দ্রুত সচেতনতা বৃদ্ধি দরকার। অন্যথায় আগামিদিনে বাঘ 'অদৃশ্য' হতে সময় লাগবে না।
