জলের তলায় শহর কলকাতা! ‘সিটি অফ জয়’ এখন যেন ‘সিটি অফ সরো’। যে দিকে দু’চোখ ধায়, সর্বত্রই শুধু জল আর জল! ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট, এন্টালি, রাজাবাজার, কলেজ স্ট্রিট, শিয়ালদা, দমদম, নিউটাউন, পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট, যাদবপুর, টালিগঞ্জ – দিকচিহ্নহীন প্লাবনে আলাদা করে চেনার আর কোনও জো নেই। এরই মধ্যে কোনওরকমে জেগে আছে বহুতলগুলোর মাথা, কয়েকটা উড়ালপুল, নগরায়নের কোপ থেকে রক্ষা পাওয়া গুটিকয় মহাবৃক্ষ, ভিক্টোরিয়ার পরী আর দুই হুগলি সেতুর জং ধরা রেলিং কটা শুধু! জলে চতুর্দিকে মানুষ, পশুর মৃতদেহ। বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে জীবজন্তুর পচা গন্ধে। শুধু কি কলকাতা? বানের তোড়ে অবলুপ্ত বাণিজ্যনগরী মুম্বই। লখনউ-পুণে-সুরাট-দিল্লি-মথুরা-আগ্রা-নাসিক-কানপুর-এলাহাবাদ-পাটনা-বারাণসী-কটক-গুয়াহাটি-বেঙ্গালুরু-চেন্নাই-কোয়েম্বাটুরও খাবি খাচ্ছে থই-থই বন্যার মারণ ফাঁসে। ভাসছে ঢাকা, টোকিও, হংকং, মায় বোস্টন, বার্লিন, ওয়াশিংটন। শেষের সেই দিন কি আসন্ন?
না। এই মর্মান্তিক সংবাদ এখনও সত্য নয়। নেহাতই কল্পনা। কিন্তু এ’দেশের ক্লাইমেট কন্ট্রোল ও ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক-সহ দুনিয়ার তাবড় তাবড় পরিবেশ বিষয়ক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, আগামী অর্ধশতকের মধ্যে আজকের এই কল্পনাই সত্য সংবাদ হতে চলেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের লাগামছাড়া পরিণামে। তবু ধরিত্রীর শুশ্রূষা করার তাগিদ দেখা যাচ্ছে কতটাই বা? নিয়ম করে ফি বছর জলবায়ু সম্মেলন, আলোচনাসভা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভের লাভ, যাকে বলে, সুদূর-পরাহত। বরং এসবের ফাঁক গলেই আরও খানিকটা আয়ু কমে আসছে পৃথিবীর। ২০২১ সালটাও চলে গেল। তবে এ বছর সবটাই হয়ত এতটা হতাশাজনক নিয়ে। এবার বিশ্বের দরবারে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে পরিবেশ রক্ষায় ভারতের ভূমিকা। প্রথম বিশ্ব উদাসীন, অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশ ভারত এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর অসুখ সারাতে। এ বছরের শেষে আসুন, সেই আশার শুনিয়ে পরিবেশ বদলের মতো গুরুতর সমস্যার দিকে নজর রাখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
মার্চ ২৬, ২০২১
একের পর এক বিধ্বংসী টর্নেডো (Tornado) আছড়ে পড়েছে আলাবামায়। আমেরিকার (US) দক্ষিণাঞ্চলের এই প্রদেশে রীতিমতো তাণ্ডব চালাল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ের প্রকোপে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত বহু। আকাশে হাতির শূঁড়ের মতো কালো মেঘ এসে তছনছ করে দিয়েছে ঘরবাড়ি, গাছপালা। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগহীন। কার্যত বিধ্বস্ত জনজীবন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের তাণ্ডবের নানা ছবি। দেখা যাচ্ছে, ওহাটচি অঞ্চলের কাছে বিভিন্ন বাড়ি কার্যত পাঁপড়ভাজার মতো গুঁড়িয়ে দিয়েছে টর্নেডো। কোথাও বা উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে ঘরের ছাদ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিত অত্যন্ত ভয়াবহ।
মে ২৬, ২০২১
ঘড়ির কাঁটা ধরে নির্ধারিত দিনে ওড়িশার (Odisha) ধামড়ায় আছড়ে পড়ে ‘যশ’ নামের অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। এই ‘যশ’ বা ইয়াস শব্দটির অর্থ হতাশা। প্রকৃত অর্থেই বাংলার বুকে একরাশ হতাশা ছড়িয়ে বিদায় নেয় ‘যশ’। প্রায় ১৫৫ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। দিঘায় প্রায় ৩০ ফুটের উপরে জলোচ্ছ্বাস, ভেসে যায় গাড়ি। তছনছ হয়ে যায় সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার একাধিক হোটেল। দিঘা শহরে ঢুকে পড়ে জল। ‘যশে’র প্রভাবে কার্যত তছনছ হয়ে যায় সমুদ্র সৈকত দিঘা (Digha)। দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায় একের পর এক কাঁচাবাড়ি ভেঙেছে। আশ্রয় হারিয়েছেন অগণিত মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হলেও রাজ্য প্রশাসনের তৎপরতায় প্রাণহানি অনেকটাই রোখা সম্ভব হয়েছে। তছনছ হয়ে যাওয়া দিঘা উপকূলকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই পরিকল্পনার নীল নকশা ছকে দিয়েছেন। সেইমতো চলছে পুনর্গঠনের কাজ।
সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১
অর্ধশতাব্দী পর ঘুম ভেঙে ভয়াবহ হয়ে উঠল স্পেনের আগ্নেয়গিরির। লাভা উদগীরণ করে নিজের সর্বনাশী রূপ দেখাচ্ছে স্পেনের (Spain) ক্যানারি দ্বীপের কুম্বরে ভিয়েখা। সঙ্গে ভূমিকম্প। অগ্ন্যুৎপাতের দাপটে ভেঙেছে আশেপাশের প্রচুর ঘরবাড়ি। কুম্বরে ভিয়েখার রুদ্ররূপ দেখে ভয়ে এলাকা ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। কুড়ি-কুড়ি নয়, গুনে গুনে ৫০ বছর পার। শেষবার ১৯৭১ সালে জেগে উঠেছিল আগ্নেয়গিরি। তারপর সেপ্টেম্বরে অগ্ন্যুৎপাতের জেরে আগুনরঙা হয়ে উঠেছে ক্যানারির আকাশ।
সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১
ছাব্বিশের গেরোতেই যেন আটকে ঘূর্ণিঝড়ের কাঁটা। ‘গুলাব’ নামের আড়ালে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড়। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখ ওড়িশার দক্ষিণ-অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরে কলিঙ্গপত্তনমের উপর দিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করার কথা ছিল ‘গুলাব’-এর। তার প্রভাবে ওড়িশা ও অন্ধ্র উপকূলে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা আগেই জানা গিয়েছিল। সকালের প্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছিল, বাকি দিনটা কেমন যাবে। সন্ধেয় গুলাব আছড়ে পড়ার পর বাড়তে থাকে বৃষ্টি। সেইসঙ্গে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে বইছে হাওয়া। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। শ্রীকাকুলাম জেলা প্রশাসনের তরফে বহু মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে। তবে এদিন সন্ধেয় নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হন ৬ মৎস্যজীবী। এদের মধ্যে ২ জনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
অক্টোবর ১৫, ২০২১
মাত্র ৫ বছর। তার মধ্যেই অন্তত ১০ থেকে ২০ শতাংশ বরফ গায়েব। বিশ্বের দুই মেরুর হিমবাহের এমন দশা দেখে মাথায় হাত বিজ্ঞানীদের। বিশেষত সুইজারল্যান্ডের হিমবাহের গলন সবচেয়ে বেশি। আরও চমকে ওঠার মতো তথ্য – সুইজারল্যান্ডের অন্তর্গত আল্পসের পিজল নামের হিমবাহ, যা নাকি বিংশ শতাব্দী থেকে গলছে, সেটি এবার পুরোপুরিই হারিয়ে গিয়েছে। ‘সুইস অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর একটি রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের হিমবাহ গলেছে রেকর্ড হারে। এপ্রিল থেকে জুন – এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৬ মিটার গভীরতা পর্যন্ত গলেছে সুইজারল্যান্ডে হিমবাহগুলি। এই পরিমাণ ঠিক কতটা, তা বোঝাতে গিয়ে সহজ তুলনা টেনেছেন গবেষকরা। গোটা দেশে বছরে যতটা পানীয় জলের প্রয়োজন হয়, প্রায় সেই পরিমাণ বরফ গলে গিয়েছে ওই তিন মাসে।
অক্টোবর ২৫, ২০২১
এই শতাব্দীর মহামারী হয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। এর অভিশাপ কতদিনে কাটবে, ঠিক নেই। তারই মধ্যে বিজ্ঞানীরা শুনিয়েছেন নতুন আশঙ্কার কথা। মেরুর বরফ গলতে গলতে নিচের স্তর থেকে বেরিয়ে আসবে বহু যুগ ধরে চাপা পড়ে থাকা অজানা সব জীবাণু (Virus)। এমনকী বেরিয়ে আসতে পারে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও। সেই পাঁচের দশক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে চলা শীতল যুদ্ধের বিপদ ফের মূর্তিমান হয়ে উঠতে পারে। বিজ্ঞানীদের সাবধানবাণী, সেসময়ে ব্যবহৃত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর, সাবমেরিন থেকে নিঃসৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থই হতে পারে বর্জ্য বিপদের উৎস।
ডিসেম্বর ২০, ২০২১
বিপর্যয়ের নাম টাইফুন রাই (Typhoon Rai)। বছরশেষে তা আছড়ে পড়ে তছনছ করে দিয়েছিল ফিলিপিন্সকে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, টাইফুন রাই থেকে বাঁচতে ঘরছাড়া কমপক্ষে ৩ লক্ষ মানুষ। একে একে ২০৮ টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। ফিলিপিন্স প্রশাসনের বক্তব্য, ২০১৩ সালে সুপার টাইফুন হাইয়ানের জেরে যেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, এবারও টাইফুন রাইয়ের দাপটে ক্ষতিও তারই সমান।
ক্যালেন্ডার ধরে এগোলে এই বিপর্যয়ের তালিকা অসংখ্য। এ বাদ দিলেও অশনি সংকেত আছে আরও। আগামী দিনে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া নিয়ে উদ্বেগের বার্তা দিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। বৃষ্টির প্রাবল্য বাড়ার ফলে বন্যার পাশাপাশি তাপপ্রবাহ ও খরার কবলেও ঘনঘন পড়তে হবে। সেই সঙ্গে থাকবে সাইক্লোনের রক্তচক্ষু। বিশ্বব্যাপী এই খরার পিছনে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি দায়ী। গড়ে ১.৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। জলের বাষ্পীভূত হওয়ার পরিমাণ বাড়বে, কমবে মাটির আর্দ্রতা। তাতেই তৈরি হবে খরার পরিবেশ। এদিকে বদলে যাবে বর্ষার গতিপ্রকৃতি। যেভাবে গত কয়েক দশকে দ্রুতহারে নগরায়ন হয়েছে, এখন তারই ফল ভুগতে হচ্ছে বলে মত তাঁদের। তবে সব দেশ মিলে যদি গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে সম্মত হয়, তাহলে তাপমাত্রা স্থিতিশীল হয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। বিপজ্জনক তথ্য আছে আরও – গত ৫ মাসে ১২.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে শুধুমাত্র পরিবেশ বদলের কারণে।
কিন্তু সবটাই এত হতাশার নয়। পরিবেশ রক্ষায় প্রথম বিশ্ব ঠিক যতটা উদাসীন, যতটা ব্যর্থ, তৃতীয় বিশ্ব সাফল্যের নিরিখে তার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। এ বছর ভারতের ভূমিকা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। ২০২১এর রোমে (Rome) আয়োজিত G-20 সম্মেলনের ছবি বিশ্বের আসন্ন বিপদ টের পেলেও কোনও প্রতিশ্রুতির পথেই হাঁটলেন না বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানরা। কোনও যৌথ পরিকল্পনা ছাড়াই রবিবার রোমে শেষ হয়ে গেল জি-২০ সম্মেলন। তারপর প্রায় সকলেই উড়ে গেলেন গ্লাসগোয়, আরেক পরিবেশ সম্মেলনে যোগ দিতে। রোম-গ্লাসগোর পরিবেশ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য সকলেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মানছেন। মাথা হেঁট হয়েছে বাইডেন, জনসনদেরও।
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বকে কার্বন নিঃসরণ (Carbon emission) শূন্য করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে। নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন, ২০৫০ নয়, ২০৬০। কারও আবার মত, ২০৫০ অনেকটা দেরি। তার আগেই কার্বনমুক্ত করতে হবে বিশ্বকে। এ নিয়ে ৩০ এবং ৩১ তারিখ দফায় দফায় বক্তব্য রেখেছেন সকলে। নিজের দেশের পরিবেশ সুরক্ষা, পদক্ষেপ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন মোদিও (Narendra Modi)। তিনিই বরং এ বিষয়ে অনেকটা এগিয়ে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে, পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কীভাবে ভারত পরিবেশ রক্ষার পথে হাঁটছে, তা বিশদে ব্যাখ্যা করেন মোদি। আর ২০২১এ ভারতের এই ভূমিকাকে প্রাপ্তি হিসেবে ধরেই আমরা আগামী দিনে শুভত্বের পথে এগিয়ে যাব আমরা।