ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: সুন্দরবনকে বাঁচাতে, সেখানকার ম্যানগ্রোভের অরণ্যকে বাঁচাতে, জনবসতিকে রক্ষা করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, সুন্দরবনের বন-প্রকৃতি তাকে আপন করে নিচ্ছে। বুধবার শহরে বনদপ্তরের আধিকারিক ও অর্থ দপ্তরের অতিরিক্ত মুখ্য সচিবকে নিয়ে নেচার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটির উদ্যোগে একটি ওয়ার্কশপ হয়। সেখানেই সকলে একযোগে স্বীকার করলেন, সুন্দরবনের পুরনো চেহারা ফেরাতে মানুষ যে বিকল্প ব্যবস্থা সামনে এগিয়ে দিয়েছে, তাকে আপন করে নিচ্ছে সেখানকার প্রকৃতি।
এই সুখবরের সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসেছে তিনটি বাস্তব চিত্র। সেগুলি হল -
প্রথমত, ম্যানগ্রোভের বনভূমি বাঁচাতে যা যা করা দরকার ছিল তার মধ্যে অন্যতম, জনবসতির স্থানান্তর। স্বেচ্ছায় সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত ভাঙনের আতঙ্কের জীবন ছেড়ে সরে আসতে চেয়েছেন। ম্যানগ্রোভ কেটে জমির চরিত্র নষ্ট করে ফেলায় সমুদ্রের গ্রাসে চলে যাচ্ছিল মূল ভূমির অনেকটা অংশ। জনবসতিকে পিছিয়ে এনে তার সামনে নতুন করে ম্যানগ্রোভের প্রাকৃতিক বাঁধ দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাই ছিল একমাত্র উপায়। হচ্ছেও তাই।
দ্বিতীয়ত, ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ির চাষ মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রশাসনের। স্থানীয় অর্থনীতির কথা ভেবে বিকল্প জায়গায় একদিকে তার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা করে, তারই লাগোয়া জমিতে ম্যানগ্রোভের বড় গাছের বাঁধ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তাতে প্রকৃতি আর স্থানীয় অর্থনীতি - দুই রক্ষা পাচ্ছে।

তৃতীয়ত, বনদপ্তরের প্রাক্তন কর্তা প্রদীপ ব্যস একটা আপ্তবাক্য বললেন যা শিহরন ধরাবে। বললেন, "আমরা তো সরকারি সংরক্ষক। প্রাকৃতিক কনজারভেটর আসলে সুন্দরবনের ভিতরেই আছে। সে হল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সে-ই আসলে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একমাত্র এই বাংলার ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে সেই রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ। না হলে মানুষ কবেই বনভূমি সাফ করে দিত।"
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারই সুন্দরবনকে রক্ষা করছে। ফাইল ছবি।
দেশের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের নাম করলেই সঙ্গে সঙ্গে মনে আসত সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির কথা। কারণ অনবরত বদলাতে থাকা আবহাওয়া আর স্থানীয়দের মধ্যে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক চাহিদার প্রভাব। কিন্তু এবার সামনে আসতে শুরু করেছে ভালো খবর। শুধু ম্যানগ্রোভের বনভূমি নয়, তার সামনে আরও একটি বাঁধ দরকার ছিল, তা-ও প্রাকৃতিক। দরকার ছিল বালিয়াড়ির। সেসবেরও ব্যবস্থা চলছে। অর্থদপ্তরের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব প্রভাত মিশ্র, প্রদীপ ব্যস ছাড়াও এদিন ছিলেন সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের কর্তা নীলাঞ্জন মল্লিক-সহ একাধিক গবেষক ও প্রশাসক।
নীলাঞ্জনবাবু জানালেন, আমফানের পর ভূমিক্ষয় রোধে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভের চারা পোঁতার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই বছর ৫ কোটি চারা বসিয়ে তার পরের বছর বসানো হয়েছিল আরও ১৫ কোটি। সব এখন সুন্দরবনের রক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাত মিশ্রের কথায়, "চিংড়ির চাষের জন্য ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলা হচ্ছিল। সেটাই কাল হয়েছিল। মূল ভূমি উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় সমুদ্র আছড়ে পড়ে পাড় ভাঙতে ভাঙতে এগোচ্ছিল। বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজে জনবসতির সঙ্গে অর্থনীতি দুইয়ের কথাই ভাবা হয়। তারই ফল মিলেছে।" প্রদীপ ব্যসের কথায়, "আমরা যখন দায়িত্বে ছিলাম, ফিল্ড সার্ভে করে জানতে পারি যে, মানুষ বাঘের ভয়েই জঙ্গলের ভিতরে কম যায়। তাঁরা সেটা বলেওছিলেন। বলেছিলেন যে, বাঘ না থাকলে কবেই গোটা ম্যানগ্রোভ সাফ করে আরও ভিতরে গিয়ে বসতি স্থাপন করতাম।"
শেষমেশ আমফান, যশের মতো সাইক্লোনে বদলাতে থাকা আবহাওয়াই মানুষের মনে ভয় ধরিয়েছে বলে জানালেন প্রভাত মিশ্র। তাঁর কথায়, "আমরা তাঁদের সরিয়ে বিকল্প বসতির কথা বলতেই সকলেই প্রায় রাজি। কারণ ম্যানগ্রোভ না থাকায় ভঙ্গুর জমিতে তাঁরা রাত কাটাতে ভয় পেতেন। তখনই সরকারি উদ্যোগে সকলকে সুমদ্রের গ্রাস থেকে সরিয়ে আরও পিছিয়ে এনে বিকল্প বসতির ব্যবস্থা হচ্ছে।''