মলয় কুণ্ডু ও অভিরূপ দাস: বর্ষার দুপুরে স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িটার চারিদিকে মনকেমন করা শূন্যতা। অবহেলার গাছগুলো ভীষণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কার্নিশ কঙ্কালসার। পাঁচিলের একপাশ ভেঙে আগাছার জঙ্গল। ওই তো সেই দু’তলার গোল বারান্দাটা।
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল চারিদিক। পাড়ার প্রবীণরা স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন আজও। ‘মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়, শাওনকে কুছ ভিগে ভিগে দিন…’।
জং ধরা লোহার রডের দিকে একমনে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন তিনি। গোলবারান্দাটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলেন, “ওইখানে বসেই পঞ্চম হারমোনিয়াম বাজাত। কত বিখ্যাত সব সুরের সৃষ্টি হয়েছে এখানেই। কিন্তু আজ…”।
[ OMG! সানি লিওনের পর ‘বিগ বস ১২’-এ দেখা যাবে এই পর্নস্টারকে! ]
সম্পর্কে রাহুল দেববর্মনের মামা অভিজিৎ দাশগুপ্ত। থাকেন লাগোয়া বাড়িতেই। সেই কবেকার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে অভিজিৎবাবুর,-“রাহুল পাকাপাকিভাবে মুম্বই চলে যাওয়ার আগে এ বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে যায় তারই এক বন্ধুকে। বাবাকে মণিদাদু বলত ও। বন্ধুকে ফোন করে বলেছিল, মণিদাদুর বয়স হয়েছে। একার পক্ষে এত বড় বাড়ির দেখভাল করা সম্ভব নয়। একটু দেখিস।”
রাহুলের বয়স তখন মাত্র ছয়। সালটা ১৯৪৫। ৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্কেই বসতবাড়ি তৈরি করেছিলেন শচীন দেববর্মন। ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় এসে শচীন কর্তার বোধহয় প্রেমই হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণের সঙ্গে। ঢাকুরিয়াতেই তখন আটকে ছিল কলকাতার ঠিকানা। ব্রিজের নিচের রাস্তা তাই আজও ‘সাউথ এন্ড’। সেই বাড়ির সামনের ভেঙে যাওয়া মার্বেল ফলকে এখনও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। কিন্তু গানের গল্প একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে পলেস্তারা খসার সঙ্গে সঙ্গে। যে শহরকে ভালোবেসে পরিবার নিয়ে সংসার পেতেছিলেন, যে বাড়ির বাঁধানো লনে কেটেছে রাহুল দেববর্মনের শৈশব, যে ইটের দেওয়ালে কান পাতলে কত অনন্য সুরের ইতিহাস হঠাৎই ছন্দ খুঁজে পায়, সেই দেববর্মন পরিবারের বসতবাটি একরাশ চাপা অভিমান নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসের পথ চেয়ে।
[ নিন্দুকদের মুখে ছাই, প্রথমদিনই বক্স অফিসে ঝড় তুলল সলমনের ‘রেস থ্রি’ ]
মুম্বইয়ে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করার আগে পর্যন্ত এখানেই কাটিয়ে গিয়েছেন শচীন দেববর্মন। আরব সাগরের তীরে যখন পা দেন তখন ১৯৫৩ সাল। রাহুলকে রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন এই বাড়িতেই। ক্লাস এইট পর্যন্ত রাহুলের বড় হয়ে ওঠা এখানেই। এখনও দক্ষিণ কলকাতার এই পাড়ায় জনা চারেক এমন বন্ধু রয়েছেন, পাড়ার গলিতে যাঁরা রাহুলের সঙ্গে আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট খেলতেন। অকপটে বলে চলেছেন অভিজিৎবাবু, “সাড়ে চার কাঠার উপর তিনতলা বাড়ি। এক সময় বাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন মারোয়াড়ি এক মহিলা। বাড়িটি ভেঙে আবাসন করবেন ভেবেছিলেন। ভাবতেই কেমন লাগছে। এতবড় ইতিহাস নষ্ট হয়ে যাবে?”
আচমকাই রাহুল চলে আসতেন ঢাকুরিয়ার এই বাড়িতে। থাকতেন বেশ কয়েকদিন। তারপর ফের মুম্বই। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসত সুর। গানের ছন্দে যেন প্রাণ পেত সাউথ এন্ড পার্ক। এখন কোথায় কী? বিষাদ খেলা করে পঞ্চমের মামার চোখে, “সে সময় দায়িত্ব নিয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এই বাড়িটিকে হেরিটেজ গ্রেড টুয়ের তালিকাভুক্ত করে দিয়েছিলেন। বুলডোজারের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সেভাবে সংরক্ষণ হল কই। এমন ইতিহাসের খোঁজ কেই বা রাখে।”
[ প্রথম জামাইষষ্ঠীতে কী করছেন রাজ-শুভশ্রী ও অর্জুন-পাওলি? ]
এ পাড়ার আর সকলের মতো অভিজিৎবাবুরও ইচ্ছে মিউজিয়াম করা হোক বাড়িটিকে। হতে পারে একটা গবেষণাকেন্দ্রও। বিষয়টি শুনে তৎকালীন মেয়র বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানালেন, “বাড়িটিকে হেরিটেজ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই বাড়িটিতে মিউজিয়াম অথবা গবেষণা কেন্দ্র হলে খুবই ভাল হয়। এর জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দেববর্মন পরিবারের লোকেরা অবিলম্বে যোগোযোগ করুন। এমন দু’জন মানুষ এখানে থাকতেন। তা ভেঙে পড়ছে শুনে খুবই খারাপ লাগছে।”
যে বাড়ির দুই প্রজন্ম ভারতের সঙ্গীত জগৎকে শাসন করেছেন সেই শচীন-রাহুল জুটির মিউজিয়াম করার জন্য অপ্রকাশিত গান, ছবি, পত্র পত্রিকা থেকে শুরু করে বহু স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র নিজের সংগ্রহে আগলে রেখে দিন কাটাচ্ছেন অভিজিৎবাবু। সে সবই দিয়ে দিতে চান দেববর্মনদের নিয়ে গড়ে তোলা মিউজিয়ামে। দক্ষিণ শহরতলি পাড়ার দাবি “এই রাস্তাটার নাম হোক দেববর্মন পার্ক।”
মিউজিয়াম চান ওঁরা
প্রতীক চৌধুরি: তাঁর গান গেয়ে কতজন করে খাচ্ছেন। আর তাঁদের বাড়ি অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা হোক।
নচিকেতা: আর ডি বর্মন লেজেন্ড। তাঁর বসতবাড়িতে মিউজিয়াম হবে এটা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়।
রাঘব চট্টোপাধ্যায়: আমি নিজে একাধিকবার বাড়িটায় গিয়েছি। সংগীতপ্রেমীদের কাছে বাড়িটি নস্টালজিক। বাড়িতে মিউজিয়াম হোক। তার জন্য আগাম ধন্যবাদ রাজ্য সরকারকে।
গৌতম ঘোষ: পঞ্চমদা আড্ডায় বাড়িটার কথা খুব বলতেন। বাড়িটা ভেঙে পড়ছে শুনে খারাপ লাগছে। সারিয়ে কিছু করা হোক।
পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার: ওই বাড়িতে পঞ্চমদার ছোটবেলা কেটেছে। অনেকে ওঁর গান গেয়ে রোজগার করছেন। মিউজিয়াম হলে খুশি হব।
অমিত রায়: এখনকার প্রজন্মকে জানাতে হবে আরডির সৃষ্টির কথা। যদি বাড়িটায় মেমোরিয়াল হয় তাহলে গোটা বিশ্ব জানবে। (সভাপতি, মেলোডি চাইম)
The post সাউথ এন্ডে বিষাদের সুর, ভেঙে পড়ছে শচীন কর্তার জলসাঘর appeared first on Sangbad Pratidin.