সন্দীপ্তা ভঞ্জ: এই কলকাতা শহর কতটা নিরাপদ প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের জন্য? চাকরীর জন্যে সন্তান-সন্ততিরা হয়তো বিদেশে থাকেন। কেউ বা আবার দেশে থেকেও ব্যস্তজীবনে সময় পান না বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখতে আসার। অতঃপর বুড়োবুড়িকে থাকতে হয় একলা। আর সম্বল যদি হয় একলা বাড়ি, তাহলে তো কথাই নেই! গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো দাঁড়ায় তা। ওই বিশাল বাড়ির উপর শকুনের মতো চোখ পড়ে জমি দালালদের। প্রোমোটারদের চা খাওয়ার ছল করে এসে শাসানি থেকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার নানা প্রচেষ্টা, চলতেই থাকে। এর থেকেও হতে পারে মারাত্মক কিছু। ঘটে যেতে পারে খুনের ঘটনাও।
সম্প্রতি, নেতাজি নগরের জোড়া খুনের ঘটনার কথাই ধরুন। বাড়ি দখলের জন্য খুন বৃদ্ধ দম্পতি। যেই অপরাধের নেপথ্যে প্রোমোটারেরই যোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেন বারবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে খাস কলকাতার বুকে? প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের নিরাপত্তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। আর সেই ভাবনাই নিজেদের ছবিতে তুলে ধরেছেন টলিউডের পরিচালকজুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায়। আর শিবপ্রসাদ-নন্দিতা মানেই ভিন্ন স্বাদের মোড়কে রোজকার জীবনের চালচিত্র তুলে ধরা এক আস্ত দলিল।
তাই দর্শকদের জন্য যে এক ভাল উপহার অপেক্ষা করে রয়েছে, ট্রেলার দেখার পর তা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। রাতের অন্ধকার বা প্রকাশ্য দিনের আলোয় তা কতটা নিরাপদ শহরের বুকে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া? উত্তরটা হয়তো বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ঘাটলেই বোঝা যাবে। বাড়ির বয়স্কদের দেখাশোনা করার জন্য হঠাৎ একদিন আমরা যে কাউকে নিয়ে এসে হাজির করি, সেটা কি আদৌ নিরাপদ? উত্তর দিলেন নাইজেল আক্কারা।
“আপনার বাড়িতে যখনই কাউকে রাখবেন তাঁদের ন্যায্য পরিচয়পত্র অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত।”
নাইজেলের কথায়, “সম্পত্তি সংক্রান্ত ব্যাপার, বাড়ি দখল কিংবা এরকম নানান ধরনের ইস্যু নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রায়ই ভুগতে হয়। বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে বয়স্কদের একা থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। অনেকেই আছেন অবসর নেওয়ার পর বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, যাদের দেখাশোনা করার জন্য কেউ নেই। তখনই একজন হেল্পিং হ্যান্ডের দরকার পড়ে। তবে যে কাউকে নিয়ে হাজির করলাম, সেটা কিন্তু মোটেই নিরাপদ নয়। দেখেশুনে বাড়ির কেয়ারটেকার বাছুন।”
তা কীরকম লোক বেছে নেওয়া উচিত? নাইজেলের উত্তর, “কোনও রেজিস্ট্রেশন করানো এজেন্সি থেকে লোক র্নিবাচন করুন। কারণ আপনার বাড়িতে যখনই কাউকে রাখবেন তাঁদের ন্যায্য পরিচয়পত্র অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত। কারণ, সংশ্লিষ্ট ওই এজেন্সি থেকে তাদের পরিচয়পত্র এবং ওই ব্যক্তি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য থানায় জমা দেওয়া থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনেকাংশেই আপনি নিরাপদ।”
এর পাশাপাশি নাইজেল জানান যে, “আমার সংস্থা থেকে যাদেরই কর্মসংস্থান হয় তাঁদের যাবতীয় তথ্য আমাদের কাছে থাকে। এমনকী, আমার কোম্পানির সুপারভাইজারও সেই বাড়িতে গিয়ে দেখে আসে মাঝেমধ্যে যে সে ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। এই তো বালিগঞ্জেরই একটি বাড়িতে, যেখানে এক প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া একা থাকেন বিশাল জায়গার উপর বাড়ি তাদের, সেখানেও আমার লোক কাজ করছে।
[আরও পড়ুন: ‘প্রলয়’-এর পর ফের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ছবি রাজ চক্রবর্তীর, রয়েছেন পার্নোও]
“কেন একটা মুসলমান ঘরের ছেলে হিন্দুর বাড়িতে জন্মাষ্টমীর দিন গোবিন্দভোগ পরিবেশন করতে পারবে না?”
জাতপাত সংক্রান্ত সমস্যা তো বটেই, তার সঙ্গে আদ্যোপান্ত পারিবারিক গল্পের মোড়কে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের নিরাপত্তা নিয়েও সওয়াল করেছে ‘গোত্র’। আসলে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই শিবপ্রসাদের ছবির গল্পে উঠে এসেছে। ‘গোত্র’র গল্প আসলে শিবপ্রসাদের মায়ের এবং তাঁর বাড়ির পরিচারকের। আর এই পরিচারকের খোঁজ শিবপ্রসাদ পেয়েছিলেন নাইজেলের কাছ থেকে। অভিনেতা তথা সমাজকর্মী নাইজেলের নিজস্ব একটি সংস্থা রয়েছে। যা জেল থেকে মুক্তি পাওয়া কারাবাসীদের নিয়ে কাজ করে। নাইজেলের সেই সংস্থা থেকেই শিবপ্রসাদ নিজের মায়ের দেখাশোনা করার জন্য ও বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে নিযুক্ত করেন একটি ছেলেটিকে।
একদিকে, মুক্তিদেবীর বিশ্বাস এবং আরেকদিকে অন্ধকার জগতের ছায়া, একসময়ে বিশ্বাস এবং বিশ্বাসহীনতার মাঝে ঝুলতে থাকে সেই ছেলেটি। আর তাঁর চরিত্রটিকেই ‘গোত্র’তে তারেক হিসেবে চিত্রায়ণ করেছেন নাইজেল। তিনিই বয়স্ক মানুষদর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি জোম্যাটোতে হওয়া সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়েও সরব হয়েছেন ‘গোত্র’র প্রসঙ্গ তুলে। ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে, মুসলিম ছেলের হাত থেকে খাবার খেতে চাইছেন না এক হিন্দু। কেন একটা মুসলমান ঘরের ছেলে হিন্দুর বাড়িতে জন্মাষ্টমীর দিন গোবিন্দভোগ পরিবেশন করতে পারবে না? সমাজের কাছে তা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না! এই প্রশ্নও কিন্তু রেখেছেন নাইজেল।