সংখ্যাই যাঁর পরিচয়। সংখ্যাতেই যিনি বাঁচতেন, যে সংখ্যাই তাঁর অভিভাবকের মতো হাত ধরে পশ্চিমী দুনিয়াতেও খ্যাতি-সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে সাহায্য করেছেন, সেই শকুন্তলা দেবীর জীবনের হিসেবই পর্দায় তুলে ধরলেন পরিচালক অনু মেনন। কেমন হল বায়োপিক শকুন্তলা দেবী? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
পরিচালক- অনু মেনন
অভিনয়ে- বিদ্যা বালান, যিশু সেনগুপ্ত, সানায়া মালহোত্রা, অমিত সাধ।
ম্যাথমেটিশিয়ান ও ম্যাজিশিয়ান
ইয়াব্বড়-বড় ক্যালকুলেশন, জটিল অঙ্কের ধাঁধা, মুখে মুখেই হিসেব কষে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন পশ্চিমী দিগগজদের। সত্যিই তো, যে দেশকে কিনা শুধু ‘সাপের দেশ’ আর ‘জঙ্গলে ভরা দেশের’ আখ্যা দিয়েছিল পশ্চিমী মানুষেরা, তাদের চিন্তাধারার হিসেবে তো গড়মিল করে দিয়েছিল এই মহিলা! সেই দেশ থেকে এমন জিনিয়াস কী করে মার্কিন মুলুকের রয়েল সোস্যাইটির মঞ্চে দাঁড়িয়ে একের পর এক হিসেব গড়গড় করে বলে সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছেন! হতবাক তো বটেই, বরং ব্রিটিশরা মন্ত্রমুগ্ধও হয়েছিলেন ভারতীয় এই মহিলাকে দেখে। ‘হিউম্যান কমপিউটার’ আখ্যাটা এমনি এমনি জোড়েনি শকুন্তলা দেবীর (Shakuntala Devi) নামের পাশে! ম্যাথমেটিশিয়ানের পাশাপাশি তাই ম্যাজিশিয়ানও বলা ভাল তাঁকে। সেই চরিত্রের জুতোতেই পা গলিয়েছেন বিদ্যা বালান (Vidya Balan)।
শকুন্তলাই এখানে দুষ্মন্ত
শুধু অঙ্ক নয়, বায়োপিকের হাত ধরে জীবনকে উপভোগ করার পাঠও দিলেন জিনিয়াস বিদ্যা বালান। মেয়েদের পায়ে পরানো বেড়িকে ভেঙে, সমাজকে উলটো প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন শকুন্তলা দেবী, স্বামীর চাকরিতে স্থানান্তরিত হলে মেয়েদের যখন ব্যাগ-পত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁর হাত ধরে, এর উলটোটা কেন হয় না? কেন একজন নারীর পেশার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পুরুষ তার ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না স্ত্রীয়ের হাত ধরে! কেন একজন মেয়েকেই বিয়ের পর শ্বশুরঘর করতে যেতে হয়, কেন জামাই এসে স্ত্রীয়ের বাড়িতে থাকাটাকে ভ্রুকুটি করা হয়? সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে চারণ করত আসলে তাঁর মনোজগৎ। যার খেসারতও দিতে হয়েছিল ব্যক্তিগত জীবনে। রাজা দুষ্মন্ত নয়, এই প্রেক্ষিতে বরং ছেড়ে গিয়েছেন শকুন্তলা নিজে! মেয়ের সঙ্গে আইনি জটিলতা, স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যায় জেরবার হতে হয়েছিল শকুন্তলা দেবীকে। আর ম্যাথ জিনিয়াসের জীবনের সেসব চড়াই-উতরাইকেই বেশ পারদর্শীতার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরেছেন বিদ্যা বালান।
[আরও পড়ুন: মৃত্যুর পরও বাঁচতে শিখিয়ে গেল ‘দিল বেচারা’র ম্যানি সুশান্ত]
অঙ্কের হিসেবের মতোই জটিল সাংসারিক জীবন
পেশাগত ক্ষেত্রে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেও শকুন্তলা দেবীর সাংসারিক জীবন কিন্তু অঙ্কের হিসেবের মতোই জটিল ছিল। সুখে ঘরকন্নায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল শুধুমাত্র অঙ্কের প্রেমে পড়েই। যার ফলে, প্রথমে স্বামী এবং পরে কন্যার সঙ্গেও সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল। সেই মহিয়সী নারী ‘শকুন্তলা দেবী’র সঙ্গে দর্শকদের এভাবেই পরিচয় করিয়েছেন বিদ্যা। তবে আক্ষেপ, শকুন্তলা দেবীর রাজনীতিক সত্ত্বা সেভাবে প্রকাশ পেল না বায়োপিকে। পরিচালক অনু মেনন যদিও সিনেমা শুরু আগেই ডিসক্লেমার দিয়ে দিয়েছেন যে বাস্তব ঘটনার আধারে তৈরি হলেও এই ছবি কোনও ডকুমেন্টারি নয়। সম্পর্কের গল্প বলার স্বার্থেই হয়তো রাজনৈতিক দিকটিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি!
স্রোতের বিপরীতে হাঁটা শকুন্তলার চরিত্রকে আত্মস্থ করতে বিদ্যার যে সেভাবে কসরতই করতে হয়নি, তা তাঁর পারফরম্যান্স দেখলেই বোঝা যায়। কী সাবলীলভাবে যুক্তি দিয়ে প্রতিটা দৃশ্যে মেয়েদের জন্য তৈরি হওয়া সমাজের রীতিনীতির জগদ্দল পাথরগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন। আবারও অসাধারণ একটা পারফরম্যান্স দর্শকদের উপহার দিলেন বিদ্যা বালান। তাঁর অভনয় দক্ষতা নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই! প্রত্যেকটা ছবিতেই বিদ্যাকে নতুন করে আবিষ্কার করেন দর্শকরা। এই সিনেমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।
অনবদ্য যিশু ও সানায়া
শকুন্তলা দেবীর স্বামী পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে যিশু সেনগুপ্তও (Jisshu Sengupta) কম যান না। একজন স্বামী এবং বাবার আবেগ-অনুভূতিগুলো বেশ পারদর্শীতার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন যিশু। বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে যেভাবে একের পর এক ছবিতে নিজের অভিনয় দক্ষতা তুলে ধরেছেন এই বাঙালি অভিনেতা, দেখলে গর্ববোধই হয় বটে। মেয়ের চরিত্রে সানায়া মালহোত্রার (Sanya Malhotra) অভিনয়ও অনবদ্য। মা-মেয়ের সম্পর্কের চড়াই-উতরাইটা সানায়া ভালোই পোর্ট্রেট করেছেন। সাপোর্টিং অ্যাক্টর হিসেবে অমিতা সাধও বেশ।
[আরও পড়ুন: অলৌকিক শক্তির মোড়কে এক বলিষ্ঠ নারীবাদের কাহিনি ‘বুলবুল’]
The post ‘শকুন্তলা দেবী’ রিভিউ: শুধু অঙ্ক নয়, জীবনকে উপভোগ করার পাঠও দিলেন বিদ্যা appeared first on Sangbad Pratidin.