shono
Advertisement

অবহেলায় স্মৃতিতে ঠাঁই ১৩৪ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের! উঠেই গেল ‘শিব্রাম’ চক্রবর্তীর মেস

তালা পড়ল জীর্ণ সেই ‘ক্ষেত্র কুঠি’-তে।
Posted: 11:51 AM Apr 17, 2023Updated: 11:51 AM Apr 17, 2023

ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ‌্যায়: কলকাতা শহরের বাড়িগুলো ঠেলেঠুলে একটু ফাঁকা জায়গা বানিয়ে হিসাব আর নম্বর টুকে রাখা দেওয়ালগুলো সংরক্ষণ করা গেলে অন্তত কিছু একটা থাকত। স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলো যেমন। লোকটার পাওনাগন্ডার হিসাব অন্তত বসে বসে দেখত গোটা শহর। সংরক্ষণ করতে চাইলে অবশ‌্য তিন-সাড়ে তিন দশক পিছিয়ে যেতে হত। সেসব দেওয়ালে চুনকাম পড়ার আগে। তবে সেই আক্ষেপের ধুলোও জল ঢেলে ধুয়ে ফেলার পর্ব শুরু হয়ে গেল এ মাসের ৮ তারিখ। নববর্ষের এক সপ্তাহ আগে।

Advertisement

মহাজাতি সদনের পাড়ায় ১৩৪ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের (Muktaram Babu Street) যে মেসবাড়িতে শিব্রাম (এই ‘বানাম’ লিখতেন নিজেই) চক্রবর্তী (Shibram Chakraborty) শেষ পর্যন্ত থাকতেন গত ৮ এপ্রিলই তস‌্য বৃদ্ধ জীর্ণ সেই ‘ক্ষেত্র কুঠি’-তে তালা পড়ল। কেউ খোঁজ নিতে এল না। ঘুণাক্ষরে কেউ টেরও পেল না। বোর্ডাররা যে যাঁর সব ছিটকে গেলেন। সে বাড়ি ভাঙা হবে। ভাঙা না হলে অবশ‌্য এমনিই ভেঙে পড়ত!

[আরও পড়ুন: মধুবনিতে খুনের পর কলকাতায় গা ঢাকা, তপসিয়া থেকে গ্রেপ্তার বিহারের কুখ্যাত গ্যাংস্টার]

এর পর হুড়মুড়িয়ে যেসব স্মৃতি, ডায়ালগ মনে আসছে, সেসব ঠেলে আরও একটি শিবরাম-ছোঁয়া মুখ ভেসে উঠেছিল। বছর ৬৭-র হাড় জিরজিরে হাঁপানির রোগী তপন মাইতি। ৪৫ বছর আগে কাঁথির বাড়ি থেকে কলকাতার এ তল্লাটে কাজ খুঁজতে এসে শিবরামের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। লেখকের শখের রান্নার দায়িত্ব এই তপনবাবুর উপরই পড়েছিল। যতদিন পর্যন্ত সাধের অমৃতি খেতে চেয়েছেন, জুগিয়েছে এই তপনই। অসুস্থতার জন‌্য এক বছর কাঁথির বাড়ি ছেড়ে বেরোননি। একটু সুস্থ বোধ করায় ৭ এপ্রিল ফের কাজে যোগ দিতে এসে জানতে পারলেন তিনি ‘বেকার’!

আর বাকি রইল শিবরামের কলকাতার এই আধা-মারোয়াড়ি পাড়া, মেসবাড়ির প্রতিবেশী কতগুলো বাড়ি, পছন্দের রাবড়ি খাওয়ার সেই মিষ্টির দোকান আর এক তীব্র স্মৃতি। যে স্মৃতির আলোপথ গিয়ে পৌঁছেছিল
ক্ষেত্র কুঠির দোতলায় মাঝখানের বারান্দায়। যার পিছনের ঘর থেকে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরে বেরিয়ে রেলিংয়ে হাত ছড়িয়ে সামনের রাস্তায় কিংবা পাশের গলিতে তিনি চেয়ে থাকতেন। কখনও তাঁর চেয়ারে বসা শরীরটার একটা পা চাপানো থাকত আরেকটার উপর।

[আরও পড়ুন: ‘উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার দৃশ্যে আমি স্তম্ভিত’, আতিক খুন নিয়ে তোপ মমতার]

সামনের কোনাকুনি এক বাড়ির সদর খুলে বেরিয়ে স্মৃতির পর্দা ঠেললেন প্রদীপ দত্ত। সে বাড়িরই আবাসিক। বছর ৪২-৪৫ আগে তখন মাধ‌্যমিক পাস করেছেন। শিবরামের পড়া হয়ে গেলে তাঁর খবরের কাগজটা আনতে যেতেন। প্রদীপ কী খেতে ভালবাসে, কী পড়তে ভালবাসে, কী কী চিন্তা করে, কোথায় কোথায় যায়– সব খুঁটিয়ে জেনে নিতেন শিবরাম। শিশু মনস্তত্ত্ব বুঝতে চাইতেন কি? সায় দিলেন প্রদীপবাবুর সঙ্গী লক্ষ্মীকান্ত মাইতি। তার পাশ কাটিয়েই প্রদীপবাবুর আক্ষেপ, “লোকটা বেঁচে থাকতে কোনও মর্যাদা পায়নি। একেবারেই উদাসীন ছিল সব।”

প্রশ্ন হল, এই উদাসীনতা কি তাঁর নিজেরও ছিল না? জীবনবিমার এজেন্টকে ভয় পেয়ে যিনি পালানোর কথা ভাবতেন, অযথা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে যিনি টেলিফোনে জ্বালাতন করতে চাইতেন যাকে-তাকে, চাঁচোলের রাজা হওয়ার সুযোগ ছেড়ে যিনি দিব্যি তক্তারামের শুক্তো আর রাবড়ি খেয়ে জীবনকে চ‌্যালেঞ্জ ছুড়তেন, তাঁকে আর যাই হোক, হিসাবি বলা যায় কি? জবাব আসে, যায়! তা না হলে ঘরের দেওয়ালে মনে করে করে হিসাব লিখে রাখবেন কেন? তাঁর যুক্তি ছিল, খাতা হারিয়ে যেতে পারে। দেওয়ালে যাবে না!

[আরও পড়ুন: সিএএ নিয়ে নেই স্পষ্ট শাহি আশ্বাস, বঙ্গ বিজেপির অন্দরে ক্ষোভ]

মেসবাড়ির যে ঘরে তিনি শেষ পর্যন্ত ছিলেন, সেখানেই সে ঘরের শেষ বোর্ডাররা ঠিক করেছিলেন একটা ট্রাস্ট করবেন। হলে নাম হত, ‘শিবরাম চক্রবর্তী ট্রাস্ট’। তা-ও এগোয়নি। আর বছর পাঁচেক পেরোলেই যে বাড়ির বয়স ১০০ ছুঁত, তার আশপাশে দাঁড়িয়ে শিবরামের নাম ধরে ডাকলে দু’-একজন যে চিনিয়ে দেবে, সে সম্ভাবনাও নেই। কারণ পুরনো দু’-এক ঘর ছাড়া তাঁকে এখন আর সেখানে কেউ চেনে না। যে দু’-এক ঘরের কথা বলা যায়, সেই দু’-এক ঘরও হাতে গোনা। সেই যে ছেলেবেলায় একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন শিবরাম, খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা ধবধবে শরীরের স্মৃতিটাও বোধহয় এতদিনে বারান্দা ছেড়ে নেমে হাঁটা লাগিয়েছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement