বিশ্বদীপ দে: জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে রহস্য। তাই হয়তো সে এত মধুময়। আর সেকথা মহম্মদ শামির চেয়ে ভালো কে আর বুঝেছে? রবিবারের বিশ্বকাপ ফাইনালে নামার আগেই তো তিনি নায়ক। সেমিফাইনালের ৭ উইকেটের মহাকাব্যের আগেও একের পর এক পাঁচ উইকেটের রূপকথা লেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বিশ্বজয় না করতে পারলেও ভারতীয় ক্রিকেটের চিরকালীন ‘হল অফ ফেমে’ ঢুকে পড়েছেন শামিও। এমন এক দিনে কি তাঁর মনে উঁকি দিচ্ছে না ফেলে আসা অতীতও? ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে চূর্ণ হওয়ার পর সেই দলের একমাত্র মুসলিম খেলোয়াড় হিসেবে কতদূর অপমানের কালো পাঁক ছুড়ে মারা হয়েছিল তাঁর উদ্দেশে? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, দিচ্ছে। দেশের প্রতিনিধিত্ব করেও দ্বেষের শিকার হওয়ার দুঃস্মৃতি সহজে কি ভোলা যায়?
সবুজ মাঠের সাফল্য-ব্যর্থতার মাঝেও শামির ধর্মকে ভুলতে পারা যায়নি। এই নতুন ভারতে মহম্মদ শামির (Mohammed Shami) ধর্মপরিচয়কে গৌণ করে তাঁর খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যকেই একমাত্র মাপকাঠি করে তুলতে পারা যায়নি! এই ব্যর্থতা আমাদের সকলেরই। অথচ খেলার মাঠে তো এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
[আরও পড়ুন: শিয়রে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন, শহর থেকে প্যান্ডেলের বাঁশ খোলার ডেডলাইন দিল পুরসভা]
এই ছবিটা একদিনে তৈরি হয়নি। মনে পড়ে বিরাট কোহলির (Virat Kohli) ছোট্ট শিশুকন্যার উদ্দেশেও ভেসে এসেছিল কদর্য হুমকি? বিরাটের ‘অপরাধ’ শামির পাশে দাঁড়িয়ে সোশাল মিডিয়ায় তাঁকে লাগাতার ট্রোল করা রুখতে আর্জি জানানো। ৩.৫ ওভারে ৪৩ রান দিয়েছিলেন শামি। আর সেই কারণে তাঁর দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল নেটিজেনদের একাংশ। সেই সঙ্গে বাছাই করা বিশেষণ। এই পরিস্থিতিতে সেই দলের ক্যাপ্টেন কোহলি আর্জি জানিয়েছিলেন, এই কুৎসিত ট্রোলিং বন্ধ হোক। লিখেছিলেন, ‘আমার কাছে, কাউকে তাঁর ধর্ম নিয়ে আক্রমণ করা সবচেয়ে জঘন্য কাজ যা একজন মানুষ করতে পারে।’ তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কাউকে তাঁর ধর্মপরিচয়ের নিরিখে বিচার করাটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না।
বিরাট কোহলি এদেশের একজন আইকন। শচীন তেণ্ডুলকর নামের জিনিয়াসের অবসরের পরে এদেশের ক্রিকেট ধর্মের নয়া অবতার। দেশজুড়ে তাঁর ভক্তকুল। এহেন জননায়কের এমন আর্তি ও সমালোচনাও কি বদলাতে পেরেছে ছবিটা? দুর্ভাগ্যের বিষয় পারেনি। দেশের কথা বলতে গিয়ে দ্বেষের পথে হেঁটে গিয়েছেন বহু মানুষ! গত বছর মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল শামিকে। কেন? না তিনি দশেরার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন সকলকে! এর পরই শুরু হয় কুৎসিত আক্রমণ। এখানেই শেষ নয়। তাঁকে দেখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলার কথাও জানা যায়।
[আরও পড়ুন: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়ান্ট স্ক্রিনে বিশ্বকাপ, মদ-মাদক-বাজি-বহিরাগতে নিষেধাজ্ঞা]
এই সব বিষতির অবশ্য উপেক্ষা করতে পেরেছেন শামি। এখানেই তাঁর জিত। ঠিক যেভাবে ব্যক্তিগত জীবনের সংকটকে সরিয়ে রেখে তিনি ফোকাস করেছেন এক এবং একমাত্র বাইশ গজে। ঠিক সেভাবেই। অথচ কাজটা সহজ ছিল না। সিনেমার চিত্রনাট্যেও এমন সব নাটকীয় উত্থান-পতন রাখতে ভয় পেতেন পরিচালক। ‘অবিশ্বাস্য’ মনে হবে ভেবে। কিন্তু সেই অবিশ্বাস্যকেই বিশ্বাস্য করে তুলেছেন শামি। মাঠে তিনি যে উইকেটগুলো নিলেন তার সঙ্গে যোগ করতে হবে ঘৃণাকে নিপাট ইয়র্কারে ওড়ানো উইকেটগুলোও। এই তো সেদিন, তিনি মাঠে বসে পড়ায় প্রশ্ন উঠল ক্লান্ত হয়েই বসেছেন নাকি প্রার্থনা করছেন!
ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে একটা বিখ্যাত প্রবাদ সকলেরই জানা। দিস ইজ নট ক্রিকেট। দিন বদলেছে। ক্রিকেটও বদলেছে বিস্তর। কিন্তু খেলার চরিত্র যতই বদলাক, তার অন্তর্নিহিত দর্শন তো বদলায়নি। তাহলে আমরা কেন তা ভুলে গেলাম? এদেশ তো চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তারকা ক্রিকেটারদেরও বীরের সম্মান দিতে পিছপা হয়নি কখনও। ১৯৯২ সালে বাবরি অধ্যায় পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে বইতে থাকা টেনশন প্রবাহকে কমাতে সাহায্য করেছিল ইডেনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের অনবদ্য ১৮২ রানের ইনিংস। ইডেনের অসাধারণ সেই জয় যেন কীভাবে বহু ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছিল। সেদিন ‘সংখ্যালঘু’ বলে কি কেউ ভেবেছিল আজহারকে? ন্যাটওয়েস্টের ফাইনালে যুবরাজের সঙ্গে মহম্মদ কাইফের অসাধারণ জুটি যখন তৈরি হচ্ছে, তখন কিন্তু ভাবতে হয়নি কাইফের ধর্ম কী। জাহির খানের নিখুঁত বোলিং দেখে মুগ্ধ হওয়ার সময়ও ধর্ম এসে পথ আগলে দাঁড়ায়নি।
কিন্তু কোথায় যেন ধীরে ধীরে এক অচেনা স্রোত এসে সব বদলে দিয়েছে। তারাপদ রায়ের কবিতার লাইন ধার করে বলা যায়, ‘আমরা বুঝতে পারিনি/ আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ হয়তো প্রেক্ষিত ভিন্ন। কিন্তু কথাগুলো এক্ষেত্রেও কেমন অব্যর্থ হয়ে ওঠে। নিজেকে এক শানিত তরবারি হিসেবে প্রমাণ করেছেন। যে অস্ত্রে ঘায়েল সব নেগেটিভিটি।
তবু, তাঁর একার ক্ষমতা নেই পাহাড়প্রমাণ এই দ্বেষকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার। সেই দায় নিতে হবে সকলকেই। এই ভারতবর্ষে বিপ্লবের আর এক নাম হয়ে উঠুক শামি। বিশ্বকাপ শেষ। আমাদের জয় সম্পূর্ণ হওয়া এখনও বাকি। কিন্তু ‘খেলতে’ পারলে সেই জয়ও অধরা থাকবে না। এই ভাঙা সময়ে এই আশাটুকুই আমাদের সম্বল। শামি পথ দেখিয়েছেন। আমাদের হেঁটে যেতে হবে।