অস্ট্রেলিয়া: ১৯৯ (স্মিথ ৪৬, ওয়ার্নার ৪১, জাদেজা ৩/২৮, বুমরাহ ২/৩৪, কুলদীপ ২/৪২, অশ্বিন ১/৩৪)
ভারত: ২০১/৪ (বিরাট ৮৫, কে এল রাহুল ৯৭*, হ্যাজেলউড ৩/৩৮)
ভারত ৬ উইকেটে জয়ী
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯:৫৫ মিনিট। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আসমুদ্র হিমাচল। চলতি বিশ্বকাপ (ICC ODI World Cup 2023) অভিযান ৬ উইকেটে জয় দিয়ে শুরু করে যেন নতুন জীবন ফিরে পেল টিম ইন্ডিয়া (Team India)। সৌজন্যে বিরাট কোহলির (Virat Kohli) লড়াকু অর্ধ শতরান। অবশ্য কেএল রাহুলের (KL Rahul) মহাকাব্যিক লড়াকু ইনিংসকেও কুর্নিশ জানাতে হবেই। ফলে শুরুর দিকে যাবতীয় ঝড় সামলে ৬ উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে (Australia) হারিয়ে কাপ যুদ্ধে নিজেদের তুলে ধরার কড়া বার্তা দিল ‘মেন ইন ব্লু’ ব্রিগেড।
মাত্র ২ রানে ৩ উইকেট চলে যাওয়ার পরেও, দুজন যেভাবে দুজন বিপক্ষের বোলারদের বুঝে নিলেন সেটা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের লোকগাথায় ঢুকে যাওয়া উচিত। তৃতীয় উইকেটে ‘চেজ মাস্টার’ বিরাট ও ঠান্ডা মাথার কেএল রাহুলের ১৬৫ রানের জুটির জন্যই একটা সময় প্রবল চাপে পড়লেও, জয় দিয়ে এবারের কাপ যুদ্ধের অভিযান শুরু করল রোহিত শর্মার (Rohit Sharma) ভারত। ৭৩.২৭ স্ট্রাইক রেট বজায় রেখে বিরাট ১১৬ বলে ৮৫ রান করেন। তাঁর ইনিংস ৬টি চার দিয়ে সাজানো ছিল। কেএল রাহুল ১১৫ বলে ৯৭ রানে অপরাজিত থাকেন। তিনি মারলেন ৮টি চার ও ২টি ছক্কা। স্ট্রাইক রেট ৮৪.৩৪।
২০০ রান চেজ করা এই ভারতীয় দলের কাছে জলভাত। তবে দলে ঈশান কিষান (Ishan Kishan) ও শ্রেয়স আইয়ারের (Shreys Iyer) মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটার থাকলে, সেই রান চেজ কতটা কঠিন হয়ে যেতে পারে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন। এরমধ্যে রোহিত দ্রুত ফিরে গেলে তো আসমুদ্র হিমাচলের রক্তচাপ তো বাড়বেই। আর সেটাই হল। ভারতের ইনিংস সবে শুরু হয়েছে। মিচেল স্টার্কের অনেক বাইরে যাওয়া ডেলিভারিকে মারতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিলেন ঈশান। শুভমান গিল (Shubman Gill) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ঈশান এতবড় সুযোগ পেলেও দায়িত্ব পালনে একেবারে ব্যর্থ।
এখানেই শেষ নয়। দ্বিতীয় ওভারের তৃতীয় ও শেষ বলে ভারতের ড্রেসিংরুমকে এবার কাঁপিয়ে দিলেন জশ হ্যাজেলউড। কোনও রান না করেই তাঁর ইনকামিং ডেলিভারিতে লেগ বিফোর হলেন ভারত অধিনায়ক। শ্রেয়স, তাঁর সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। ২ রানে ২ উইকেট চলে গিয়েছে। ঠিক এমন সময় ক্রিজে এলেন শ্রেয়স। বিন্দুমাত্র ধৈর্য দেখালেন না। আগুনে বোলিং করা হ্যাজেলউডকে কভারের উপর দিয়ে মারতে গিয়ে ওয়ার্নারের হাতে লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরলেন। মাত্র ২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন শুধু রাহুল দ্রাবিড় নন, গোটা দেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল। কারণ তিন ব্যাটারই যে তাঁদের নামের পাশে ‘শূন্য’ নিয়ে দলকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলেন। তবুও চাপের মুখে চুপসে না গিয়ে বিরাট-কেএল রাহুল সাজঘরে হাসি ফোটালেন।
[আরও পড়ুন: ‘ঘরের মাঠ’ চিপকে অজি ব্যাটিংকে উড়িয়ে জোড়া রেকর্ড, কী বললেন জাদেজা?]
সেই সময় মনে হচ্ছিল বোলারদের সব পরিশ্রম জলে গেল! কিন্তু বিরাট ছিলেন। সঙ্গে পেয়ে গেলেন কেএল রাহুলকে। সরি, ভুল লিখলাম এটা যেন ‘কেএল রাহুল টু’। বিরাটকে শুরুতে নড়বড়ে দেখাচ্ছিল। ৭.৩ ওভারে সেই হ্যাজেলউড ভারতের ব্যথা আরও বাড়াতে পারতেন। তাঁর শর্ট বল হুক মারতে গেলে ‘মিস টাইম’ করেন বিরাট। যদিও সহজ ক্যাচ ফস্কান মিচেল মার্শ। তবে কেএল রাহুল ছিলেন নিজের ছন্দে। এশিয়া কাপে কামব্যাক করার পর থেকে ফর্মে রয়েছেন। এদিন কঠিন পিচেও শান্ত মেজাজে বিপক্ষের বোলারদের বুঝে নিলেন।
দুই অভিজ্ঞ থান্ডা মাথায় ক্রিজে থিতু হয়ে স্কোরবোর্ডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। তিন অজি পেসারকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলে নেওয়ার জন্য তাঁদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। আর তাই অ্যাডাম জাম্পাকে মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হয়নি। যত সময় এগিয়েছিল বিরাট যেন তাঁর ‘চেজ মাস্টার’ ভূমিকায় ধরা দিচ্ছিলেন। তবে শতরান অধরা থেকে গেল। ভারতকে জয়ের দোরগোড়ায় এনে ১১৬ বলে ৮৫ রানে থামলেন ‘কিং কোহলি’।
কেএল রাহুল কম কিসের! ফিট হয়ে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কামব্যাক করেছিলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ১০৬ বলে ১১১ রানে অপরাজিত থেকে নীরবে দিয়েছিলেন স্টেটমেন্ট। এর পর থেকে নিন্দুকদের প্রতি ম্যাচেই জবাব দিচ্ছেন। কিপার হিসাবে উন্নতি করেছেন। চেন্নাইয়ের মারাত্মক গরমে কিপিং করার পর, এবার দায়িত্ব নিয়ে অজিদের বোলিংয়ের মহড়া নিলেন তিনি। ১১৫ বলে ৯৭ রানে অপরাজিত থাকলেন।
[আরও পড়ুন: চিপকের মেগা ম্যাচে কোন রেকর্ড গড়লেন বিরাট কোহলি-ডেভিড ওয়ার্নার?]
তিন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামার ছক পুরোপুরি সফল। চিপকের (Chepauk Stadium) লাল মাটির পিচ বরাবর টার্নার হয়। এবারের বিশ্বকাপে (ICC ODI World Cup 2023) এম এ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের (MA Chidambaram Stadium) পিচের রঙ অবশ্য কালচে। সেই বাইশ গজে দাপট দেখাল টিম ইন্ডিয়ার বোলিং বিভাগ। সৌজন্যে রোহিতের দুরন্ত অধিনায়কত্ব। এর পর মাঠে নেমে রবিচন্দ্রন অশ্বিন (Ravichandran Ashwin), রবীন্দ্র জাদেজা (Ravindra Jadeja) ও কুলদীপ যাদব (Kuldeep Yadav) অধিনায়কের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার (Australia) ব্যাটারদের ক্লাবস্তরে নামিয়ে আনলেন।
ফলে কাপ যুদ্ধের প্রথম ম্যাচেই দাপট দেখাল ভারতের বোলিং বিভাগ। কারণ অজিদের ইনিংস যে মাত্র ১৯৯ রানে শেষ হয়ে যায়। জাদেজা ২৮ রানে ৩ ও কুলদীপ ৪২ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন। জশপ্রীত বুমরাহ (Jasprit Bumrah) নিলেন ৩৪ রানে ২ উইকেট। অশ্বিনের ঝুলিতে এল ৩৪ রানে ১ উইকেট।
তিন স্পিনার বাইশ গজে ম্যাজিক দেখালেও, শুরুটা করেছিলেন বুমরাহ। ৩.২ ওভারের মাথায় তাঁর বাইরে যাওয়া ডেলিভারিতে খোঁচা দেন মিচেল মার্শ। প্রথম স্লিপে থাকা বিরাট বাঁদিকে উড়ে দুরন্ত ক্যাচ ধরেন। ৫ রানে প্রথম উইকেট হারায় অজিরা। এর পর অবশ্য লড়াই শুরু করেন ডেভিড ওয়ার্নার (David Warner) ও স্টিভ স্মিথ (Steve Smith)। দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার দ্বিতীয় উইকেটে যোগ করেন ৬৯ রান যোগ করেন। কঠিন উইকেটে দুজন লড়াই করলেও, বড় রানের আশায় ছিল অজি শিবির। নিজের বলে ওয়ার্নারের (৪১) ক্যাচ নিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় সাফল্য এনে দেন কুলদীপ। ৭৪ রানে ২ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। এর পর দলের রান যখন ১১০, ঠিক সেই সময় বাইশ গজে স্পিন ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে দেন জাদেজা। হাতে বল নিয়ে ফিরিয়ে দেন ফর্মে থাকা স্টিভ স্মিথকে (৪৬)। তাঁর স্পিনের জালে ফিরে যান মার্নাস লাবুশানে ও অ্যালেক্স ক্যারি।
ব্যস, এর পর অজিদের মিডল অর্ডার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। দুই স্পিনার কুলদীপ ও জাদেজা উইকেট তুলে নিলেও, অশ্বিন থেমে থাকার পাত্র নন। আগাগোড়া চেনা পিচ থেকে সাহায্য পাচ্ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে রান পেতে অজি ব্যাটারদের সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু উইকেট পাচ্ছিলেন না অভিজ্ঞ অফ স্পিনার। সেটাও পেলেন। কয়েক মাস আগে ভারত সফরে এসে দারুণ পারফর্ম করেছিলেন ক্যামেরুন গ্রিন। কাপ যুদ্ধের মঞ্চে অবশ্য অজি অলরাউন্ডার অশ্বিনের অভিজ্ঞতার কাছে দাঁড়াতেই পারলেন না।
অবশ্য গ্রিন আউট হওয়ার আগে বিপক্ষ ব্যাটিংকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন কুলদীপ। ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ছিল। এবার তাঁর শিকার হলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তাঁকে বোল্ড করতেই অজি শিবিরের বড় রান তোলার আশা জলে চলে যায়। ফলে বাইশ গজে দাপট বজায় রেখে অজিদের ১৯৯ রানে অল আউট করে দিয়েছিল ভারত। এরপর রান চেজ করতে গিয়ে শুরুতে উইকেট হারালেও, বিরাট-কে রাহুলের জুটি ভারতকে কাঙ্খিত জয় এনে দিল। একইসঙ্গে বাড়ল আত্মবিশ্বাস, যা কাপ যুদ্ধের আগামী লড়াইগুলোতে ‘মেন ইন ব্লু’ ব্রিগেডকে সাহায্য করবে।