গৌতম ব্রহ্ম: ৪৫০ গ্রাম! এই ওজন নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সে। ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, চামড়া, অন্ত্র, মস্তিষ্ক, চোখ কিছুই পুরোপুরি তৈরি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। সে যে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১৭ সপ্তাহ আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে! আয়তন এতটাই ছোট ছিল যে এক হাতেই তালুবন্দি করা যাচ্ছিল। এহেন কম ওজনের সদ্যোজাতকে বাঁচিয়ে নজির গড়ল কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের শিশুবিভাগ। যা নিওন্যাটাল চিকিৎসায় মাইলস্টোন বলেই মনে করছেন শহরের চিকিৎসকরা। কার্যত যমের সঙ্গে লড়াই করে সেই একরত্তিকে বড় করেছেন ডাক্তারবাবুরা। ৪৫০ গ্রাম থেকে নিয়ে গিয়েছেন ১৩৫০ গ্রামে! চামচ দিয়ে এখন দুধও খাচ্ছে সেই কন্যাশিশু!
তনুজা বিবি। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ থানা এলাকার বলরামপুর চিংড়িপোতা এলাকার মধ্যমগ্রামে। ১৩ মার্চ এসএসকেএমেই তনুজার সিজার হয়। এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন ২৯ বছরের বধূ। কিন্তু শিশুটি এতটাই ছোট ছিল যে মানুষের মতো দেখতে হলেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোনওটাই পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। ফুসফুস অপরিণত হওয়ায় নিজের থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল না। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তাই ঠাঁই হয়েছিল ‘নিওন্যাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’ বা নিকুতে। তার পরেরটুকু রূপকথা!
এসএসকেএমের ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা দিন-রাত এক করে যুদ্ধ শুরু করেন, শিশুটিকে বাঁচানোর। যাঁর অন্যতম কারিগর নবজাতক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শ্যামল সর্দার। তিনি জানান, “আড়াই কেজির কম হলেই সদ্যোজাতকে কম ওজনের শিশু বলা হয়। আর এর ওজন তো সাড়ে চারশো গ্রাম। এত কম ওজনের শিশুকে বাঁচিয়ে রাখাটা সরকারি তো বটেই, বেসরকারি ক্ষেত্রেও নজির। কাজটা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু দিনের শেষে আমরা শিশুটিকে ১৩৫০ গ্রামে নিয়ে যেতে পেরেছি।” শ্যামলবাবুদের সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়েছেন পার্ক সার্কাসের ‘ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ’-এর চিকিৎসকরা। ডা. প্রভাসপ্রসূণ গিরি জানান, “পাঁচশো গ্রামের নিচের বাচ্চাকে বাঁচানো খুব কঠিন। ভেন্টিলেশনে রেখে চেষ্টা করব কি না সেটাও ভাবতে হয়। আর এখানে তো শিশু মাত্র সাড়ে চারশো গ্রামের। খুবই বড় সাফল্য।”
আর এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নিশান্তদেব ঘটকের পর্যবেক্ষণ, গর্ভধারণের ২৩ সপ্তাহের মাথায় ফুসফুস পুরোপুরি তৈরি হয় না। ফলে, ৩২ সপ্তাহ পর্যন্ত ‘ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন সাপোর্ট’ দরকার। এত করেও খুব কম ক্ষেত্রেই বাঁচে। তাই শ্যামলবাবুদের কৃতিত্ব অনেক বেশি। খুশি এসএসকেএমের সুপার ডা. রঘুনাথ মিশ্রও। জানালেন, “মাইলফলক হয়ে থাকবে শ্যামলবাবুদের সাফল্য।” স্বস্তিতে তনুজা বিবির পরিবারও। জামাইবাবু মহম্মদ রুস্তম জানিয়েছেন, “তনুজার এটি দ্বিতীয় সন্তান। কম ওজন নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। এখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত।”লসাধারণত, বারোশো-তেরোশো গ্রাম ওজন হলেই শিশুকে ছুটি দেওয়া যায়। কিন্তু শ্যামলবাবুরা কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ। জানালেন, “১৬০০ গ্রাম ওজন হওয়ার পরই বাড়ি পাঠাব।” চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, এত কম ওজনের শিশুর অ্যাপনিয়া হয়, নিশ্বাস নিতে ভুলে যায়। নিজের থেকে খেতে যে রিফ্লেক্স দরকার সেটাও তৈরি হয় না অনেকসময়। তাই নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার।
২০১৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় ২৪৫ গ্রাম ওজনের এক শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সর্বাধিক কম ওজন বিশিষ্ট শিশুর রেকর্ড তারই দখলে। ২০১৮ সালে হায়দরাবাদের একটি হাসপাতাল ৩৭৫ গ্রাম ওজনের এক শিশুকে বাঁচিয়ে তোলে। এবার কলকাতা বাঁচাল ৪৫০ গ্রামের শিশুকে। এর আগেও শ্যামলবাবু কম ওজনের শিশুকে বাঁচিয়েছেন। ২০১৪ সালের মে মাসে, এই এসএসকেএম হাসপাতালেই। গড়িয়ার সাহাপাড়ার বাসিন্দা সঞ্চিতা হালদার মাতৃভবনে ৫২৫ গ্রাম ওজনের এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। ৬৪ দিনে শিশুর ওজন ১৬০০ গ্রাম করে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন শ্যামলবাবুরা। এবারের কাজটা আরও কঠিন। সাড়ে চারশো গ্রাম থেকে ১৩৫০ গ্রামে পৌঁছতে সময় লাগল ৮৫ দিন।
The post মিরাকল! ৪৫০ গ্রামের সদ্যোজাতকে প্রাণ দিয়ে নজির এসএসকেএম-এর ডাক্তারদের appeared first on Sangbad Pratidin.