shono
Advertisement
Marianne Bachmeier

ভরা আদালতে মেয়ের 'খুনি'কে গুলি করে মা, বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলেছিল 'বদলা'র কাহিনি

চার দশক পেরিয়ে আসা এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ব।
Published By: Biswadip DeyPosted: 08:15 PM Sep 21, 2024Updated: 09:00 AM Sep 22, 2024

বিশ্বদীপ দে: সিনেমায় এমন হলে দর্শকরা বলত, এসব রুপোলি পর্দাতেই কেবল হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালের জার্মানিতে (তখন পশ্চিম জার্মানি) আদালতের মধ্যে বিচারকের সামনেই খুনের আসামীকে গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছিলেন এক মহিলা। এমন রোমহর্ষক অথচ বাস্তব ঘটনায় কেবল সেদেশ নয়, আলোড়িত হয়েছিল বিশ্ব। নিজের সাত বছরের মেয়ের খুনের বদলা নিয়েছিলেন ম্যারিয়েন ব্যাকমায়ার। তার পর আস্তে আস্তে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ''ওই লোকটা আমার মেয়েকে মেরেছে, তাই আমি ওকে গুলি করেছি। চেয়েছিলাম মুখে গুলি করতে। কিন্তু পিঠে মেরেছি। আশা করি লোকটা বেঁচে নেই।''

Advertisement

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে চার দশকেরও বেশি সময়। অথচ আজও 'রিভেঞ্জ মাদার' ম্যারিয়েন ব্যাকমায়ারের নাম ফিরে ফিরে আসে। পুরো ঘটনাটি শুরু থেকে না বললে ব্যাকমায়ারকে চেনা যাবে না। গুলি চালানোর নেপথ্যে থাকা তাঁর মনটিকে বুঝতে হলে ফিরে যেতে আরও অতীতে। বুঝে নিতে হবে কে এই ব্যাকমায়ার।

ম্যারিয়েন ব্যাকমায়ার

এককথায় তিনি ছিলেন একজন স্ট্রাগলার। বিবাহ বিচ্ছিন্না। সিঙ্গল মাদার। ছোট্ট মেয়েকে বড় করে তোলার দায়ভার ছিল তাঁর কাঁধে। গত শতকের সাতের দশকে পশ্চিম জার্মানির লুবেক শহরে একটি পাব চালাতেন তিনি। সারা দিনের ব্যস্ত শিডিউলে মেয়েকে বাধ্যতই বাড়িতে অনেকটা সময় একা রাখতে হত তাঁকে। তবে ছোট্ট মেয়েও জলদি মানিয়ে নিয়েছিল পরিস্থিতির সঙ্গে। স্কুল থেকে ফিরে ফ্রিজে রাখা খাবার গরম করে খেয়ে নিত। তার পর আশপাশের বাড়িতে চলে যেত খেলা করতে। কিন্তু একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে আর ফিরে এল না। ১৯৮০ সালের ৫ মে মিলল তার দেহ।

জানা যায়, ঘটনার দিন ছোট্ট অ্যানা স্কুলে যায়নি। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। এর পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে খেলতে গিয়েই সে পড়ে যায় তাদের এক প্রতিবেশীর পাল্লায়। ৩৫ বছরের লোকটি এলাকায় রীতিমতো বদনাম। ক্লজ গ্র্যাবোস্কির নামে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ক্রাইম রেকর্ড ছিল। আশপাশের মানুষরা তাকে ঘৃণাই করত। এহেন গ্র্যাবোস্কিই নাকি অ্যানাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখে। পরে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে সে। কার্ডবোর্ডের বাক্সে দেহ ভরে ফেলে দিয়ে আসে পাশের এক খালপাড়ে। ঘটনার দিনই সন্ধ্যাবেলা তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। খবর দিয়েছিলেন তারই বাগদত্তা। নিজের হবু স্বামীর ঘৃণ্য মানসিকতা সম্পর্কে ভালোই ওয়াকিবহাল ছিলেন সেই তরুণী।

আদালতে ব্যাকমায়ার

সে কি খুনের আগে বা পরে ছোট্ট অ্যানাকে যৌন নির্যাতন করেছিল? তা অবশ্য জানা যায়নি। বরং সকলকে চমকে দিয়ে আজব এক দাবি করেছিল গ্র্যাবোস্কি। সাত বছরের শিশুকন্যাটিকেই সে উলটে অভিযুক্ত করেছিল। তার দাবি ছিল, অ্যানা তাকে ব্ল্যাকমেল করেছিল! বলেছিল, টাকা না পেলে সে মাকে গিয়ে বলবে গ্র্যাবোস্কি তার উপরে যৌন নির্যাতন করেছে।

একে তো ছোট্ট মেয়েকে হারানোর ভয়াবহ যন্ত্রণা। অন্যদিকে খুনির কুৎসিত অভিসন্ধি। ম্যারিয়েন ব্যাকমায়ারকে এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। ফলে ভিতরে দানা বেঁধে থাকা আক্রোশ ক্রমেই অস্থির আগ্নেয় তরল হয়ে ফেটে বেরতে চাইছিল। ততদিনে কেটে গিয়েছে এক বছর। এর আগের শুনানির সময় লুবেক জেলা আদালতের এককোণে চুপ করেই বসে থাকতে দেখা যেত ব্যাকমায়ারকে। কিন্তু সেই বিশেষ দিনটি ছিল একেবারে আলাদা। সেদিন ছিল ওই মামলার তৃতীয় শুনানি। ব্যাকমায়ার আদালতে প্রবেশ করলেন পার্সে পয়েন্ট ২২ ক্যালিবার বেরেত্তা পিস্তল নিয়ে। আর তার পর আটবার গুলি চালিয়ে ঝাঁজরা করে দিলেন গ্র্যাবোস্কিকে। তবে আটটা বুলেট ছুড়লেও লক্ষ্যভেদ করেছিল ছটিই।

প্রতীকী ছবি

পুলিশ গ্রেপ্তার করে ব্যাকমায়ারকে। আদালতে তাঁর আইনজীবী দাবি করেন, হরমোনের গোলমালে ভুগছেন তিনি। এবং সেজন্য তাঁর থেরাপিও চলছে। এই অসুখের ফলেই ভারসাম্য হারিয়ে এভাবে গুলি চালানোর পথে হেঁটেছেন ব্যাকমায়ার।

এদিকে খোদ ব্যাকমায়ার? তিনি কী বলেছিলেন? তাঁর দাবি ছিল, গ্র্যাবোস্কিকে তিনি এক স্বপ্নের মধ্যে হত্যা করেছেন! এবং সেই সময় কোর্টরুমে নিজের মেয়েকেও দেখতে পেয়েছিলেন। ডাক্তার হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁর হাতে কাগজ-কলম তুলে দিলে সেখানে ব্যাকমায়ার লেখেন, 'আমি তোর জন্য এটা করেছি অ্যানা।' এর পাশেই তিনি এঁকে দেন সাতটি হার্ট। সাত বছরের মেয়ের জীবনের প্রতিটি বছরের জন্য একটি হার্ট। পরে আদালতে বলেন, ''শুনেছিলাম লোকটা একটা বিবৃতি দিতে চায়। তার মানে ফের একটা মিথ্যে কথা নির্যাতিতার বিরুদ্ধে, যে কিনা আমারই মেয়ে।''

মেয়ের খুনিকে আদালতের মধ্যে গুলি করে মেরেছে মা। এ কি আইন হাতে তুলে নেওয়া নয়? নাকি এমন এক পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক? এমনই তর্ক শুরু হয়ে গেল। বিষয়টা হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক এক বিষয়। অনেকেই সমব্যথী হলেন হতভাগ্য মায়ের প্রতি। আবার এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে সরবও হলেন। অনেকদিন পরে ব্যাকমায়ারের এক বন্ধু দাবি করেন, পাব সেলারে রীতিমতো টার্গেট প্র্যাকটিস করেছিলেন তিনি। সুতরাং আবেগের বশে গুলি চালানো নয়, বরং ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন এক সন্তানহারা মা। এখানে বলে রাখা দরকার, ব্যাকমায়ারের কিন্তু তিন সন্তান ছিল। প্রথম দুজনকে তিনি দত্তক হিসেবে তুলে দেন অন্য দম্পতির হাতে। ছোট্ট অ্যানাই ছিল তাঁর সবেধন নীলমণি।

শেষপর্যন্ত আদালত ছবছরের সাজা দেয় ব্যাকমায়ারকে। জার্মানির ২৮ শতাংশ মানুষ মনে করেছিল এই সাজা একেবারে যথাযথ। ২৭ শতাংশ জানিয়েছিলেন, তাঁদের মতে লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে গিয়েছে। আবার ২৫ শতাংশের মতে, এই সাজা অপরাধের তুলনায় যথেষ্ট কম। বাকিরা ছিলেন সংশয়াচ্ছন্ন। যাই হোক, শেষপর্যন্ত তিন বছর সাজাশেষে মুক্তি পেয়ে যান ব্যাকমায়ার। তিনি নাইজেরিয়া চলে যান। ফের বিয়েও করেন। সেই বিয়েও ভেঙে যায়। কিন্তু এই সময়গুলিতেও মেয়েকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারেননি ব্যাকমায়ার।

পাশাপাশি কবরে শুয়ে মা ও মেয়ে

শেষপর্যন্ত ১৯৯৬ সালে অন্ত্রের ক্যানসারে ভুগে তাঁর মৃত্যু হয় ছেচল্লিশ বছর বয়সে। তাঁকে কবর দেওয়া হয় অ্যানার কবরেরই পাশে। মা ও মেয়ে সেই থেকে চিরঘুমে আচ্ছন্ন। পাশাপাশি, কাছাকাছি। মৃত্যুর পরে মানুষের কোনও অস্তিত্বের কথা বিজ্ঞান স্বীকার করেনি এখনও। যদি কখনও তা প্রমাণিত হয়, তাহলে হয়তো জানা যাবে, জীবনের অন্য পারে নিজের আত্মজার মুখোমুখি হয়ে তিনি বলে উঠেছিলেন, ''আই ডিড ইট ফর ইউ, অ্যানা।'' আমি তোর জন্য এটা করেছি সোনা মেয়ে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement