বাংলাদেশে জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থান কোনওভাবেই এত বড় হওয়ার কথা ছিল না। আওয়ামি লিগের প্রতি রাজনৈতিক অনাস্থা ও গণ-হতাশার চূড়ান্ত প্রকাশ এই গণ-বিক্ষোভ। লিখেছেন রাজু আলাউদ্দিন।
১৮ জুলাই ঢাকা-সহ বাংলাদেশের (Bangladesh) অন্যান্য অঞ্চলে যা ঘটেছিল তা বর্বর হত্যাযজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়। এই বর্বরতার শুরু আবু সাঈদকে হত্যার মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের উপর পুলিশ, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), সামরিক বাহিনী এবং ছাত্র লিগের সম্মিলিত হিংস্র আক্রমণ দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। এই আক্রমণ ছিল একই সঙ্গে স্থলভাগ ও আকাশ থেকে; ছিল ট্রাক, সঁাজোয়া, জলন্দাজ ও পেটোয়া বাহিনীর চতুরঙ্গ। ১৮ জুলাই দেশকে ব্ল্যাকআউটে ফেলে জনতার উপর এই আগ্রাসনের সঙ্গে ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিশেষ পার্থক্য ছিল না।
’৭১ সালে আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম বিজাতীয় সেনাদের দ্বারা, আর ৫২ বছর পর, স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আক্রান্ত হয়েছে স্বজাতীয় শাসকদের দ্বারা। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ১৫০। সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে, এই সংখ্যা ২৫০-র উপর। মতান্তরে ৩০০-র অধিক।
[আরও পড়ুন: তাঁর বিরুদ্ধে ইডি হানার প্রস্তুতি চলছে, বিস্ফোরক দাবি রাহুল গান্ধীর]
যে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ– সরকার আন্তরিক হলে শত-শত মৃত্যুর এই বেদনাদায়ক ঘটনা এড়ানো যেত। ২০১৮ সালের পর, এবার ছাত্ররা কোটা সংস্কারের কথা বলে আসছিল ১ জুলাই থেকে। কিন্তু সরকার গা করেনি। তারা সম্ভবত কল্পনাও করেনি যে, আন্দোলনটি এত দূর বিস্তৃত হবে। এরই মধ্যে এতগুলো হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী যখন জাতির উদ্দেশে ১৭ তারিখে ভাষণ দিলেন, তখনও যদি আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন, তাহলে ১৭-পরবর্তী অন্তত ২০০-র বেশি নিরীহ প্রাণ রক্ষা করা যেত। অথচ আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল, আইনমন্ত্রী ১৮ তারিখে জানালেন, ‘শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাবকে স্বাগতম, আজকেই বসতে প্রস্তুত’।
ততক্ষণে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সদিচ্ছার ব্যাপারে ঘোরতর সন্দিহান হয়ে উঠেছে। এবং তাদের সেই সন্দেহই সঠিক প্রমাণিত হল, যখন দেখা গেল, একদিকে ওই ভাষণ ও তড়িঘড়ি আলোচনার প্রস্তাব– আর অন্যদিকে, ব্ল্যাকআউটের ব্যবস্থা করে মানুষ-হত্যার লক্ষ্যে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন), সামরিক বাহিনী ও ছাত্র লীগের সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার দ্বিচারিতা। এ যেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কোনওরকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা-ত্যাগ, আর তার কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’। গত ১৮ জুলাই ছিল বাঙালি-কর্তৃক বাঙালি-নিধনের ‘দ্বিতীয় সার্চলাইট’। ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়– এই আপ্তবাক্যটি যেন ছাত্র-জনতার রক্ত পান করে নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেল।
[আরও পড়ুন: অবশেষে কুকি-মেতেইদের মধ্যে শান্তিচুক্তি, স্বাভাবিক হওয়ার পথে মণিপুর!]
প্রথম কথা, এই ছাত্র আন্দোলন এত তীব্র ও সর্বব্যাপী হয়ে উঠতে পেরেছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কেবল কোটা সংস্কারকেই একমাত্র কারণ হিসাবে দেখলে আমরা ভুল করব। এরকম গণ-অভ্যুত্থান এই ভূখণ্ডে এর আগেও হয়েছিল; প্রথমে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, পরে ’৬৯-এ, ’৭১-এ, এবং স্বাধীনতা-উত্তর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন ঘটে। ’৭১ সাল বাদ দিলে এই আন্দোলনেই সর্বাধিক সংখ্যক ছাত্রজনতা নিহত হয়েছে। গত ১৫ বছরে এই সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে এবং বিভিন্ন মৌলবাদী ইসলামি দলের আবদারে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এনেছে– তাতে পাঠ্যপুস্তক কার্যত ঠোঙায় পরিণত! যেসব ছাত্রছাত্রী দিন-রাত পড়াশুনা করে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে, তারা যখন জানতে পারে ওসব প্রশ্ন বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আবেদ আলী-রা ফঁাস করে দিচ্ছে– তখন কতটা ক্ষোভ জন্মাতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি-কোটি ডলার বিদেশি হ্যাকাররা হাতিয়ে নিল, অথচ এখানে কারা জড়িত, তা নির্ণয় করতে পারেনি সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া, বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের বোঝা, ব্যাঙ্ক থেকে কোটি-কোটি টাকা ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণ নেওয়া এবং তা বিদেশে পাচার করার পরও– সরকার কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারে না।
সরকারি বড়-বড় প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ ঘুষ-বাণিজ্য চলছে, উন্নয়ন প্রকল্পে আমলাদের লুটপাট, ৫০০ টাকার বালিশ ৫ হাজার টাকায় কেনা, সরকারি কর্মকর্তাদের পুকুর কাটার অছিলায় সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণের কথা আকছার শোনা যায়। নদী-খালবিল যথেচ্ছভাবে দখল করা হচ্ছে। আর আছে– সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তি থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নপদ পর্যন্ত ঘুষ ও দুর্নীতির অবাধ অ্যাক্টিভিটি। অভিযোগ, পুলিশের সাবেক ডিআইজি বেনজীর আহমেদ, সাবেক মেজর জেনারেল আজিজ, আয়কর বিভাগের মতিউর রহমান, কিংবা ড্রাইভার মাজেদ– অভিযোগ– এঁরা রাষ্ট্রের সর্বব্যাপী ঘুষ ও দুর্নীতির আইসবার্গীয় চূড়ামাত্র। সাধারণ মানুষের কাছে যা ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠেছে তা হল, প্রতিটি পণ্যের দ্রুতগতিতে মূল্যবৃদ্ধি। এই গতি বুলেট ট্রেনের চেয়েও বেশি বেগবান। রাষ্ট্র এর আগে এতটা অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়তো হয়নি। অনস্বীকার্য, অবকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু সেই উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ ঘুষ ও দুর্নীতির দানবের কাছে লিলিপুটের মতো গৌণ হয়ে আছে উপভোক্তার অস্তিত্ব। মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে গুম আর খুন। রাস্তায়, হাটে-বাজারে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের যৌথ চঁাদাবাজি মানুষের জীবনকে কতটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে– সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তা জানলেও প্রতিকারের ব্যাপারে উদাসীন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা হয়েছে– তা এই স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের একেবারেই পরিপন্থী।
সমাজতন্ত্রী দেশগুলোর ক্রমশই মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের কল্পরাজ্য থেকে সরে যাওয়া প্রসঙ্গে মেক্সিকোর লেখক অক্তাভিও পাস যে-কথাগুলো বলেছিলেন, তা বাংলাদেশের বর্তমান পরিণতির বেলাতেও প্রাসঙ্গিক: ‘If Marx, Engels and Lenin were to return to this world they would certainly be ashamed to find themselves beside Mao and Stalin. These two represent something radically different from Marxism in its original form: critical thinking and revolutionary action designed to liberate men from religion, authority, and the state. Here we find the opposite. Once again there is confusion between politics and religion: The leader has been deified, sanctified.’ (Seven Voices, Rita Guibert, P. 257)
শেখ মুজিব যদি ফিরে আসতেন, তাহলে কি প্রসন্ন হতেন? মানুষকে ধর্ম, রাষ্ট্র এবং কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করার পরিবর্তে অধীন করছেন কারা? বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-র বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গায় ঢুকেছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের জায়গা দখল করেছে স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের জায়গা দখল করেছে কর্পোরেট গোষ্ঠীর সংকীর্ণ স্বার্থবাদ, আর ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় ইসলামি জজবা। আওয়ামি লিগ যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে, কোথায় সেই চেতনার বাস্তবায়ন? বিপুল সংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসার দেশে ৫৬০টা ‘মডেল’ মসজিদ বানিয়ে আওয়ামি লিগ কোন চেতনার বাস্তবায়ন করছে? অথচ রাষ্ট্রের কাজ কি ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করা? আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করার সময় ধর্মনিরপেক্ষতাকেই মূলমন্ত্র হিসাবে নিয়েছিল।
এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে জামায়ত, বিএনপি ও আওয়ামী লিগ একাত্ম হয়েছিল। দ্বিতীয়বার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ১৯৯৪ সালে বিএনপি-র বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামিকে রীতিমতো আন্দোলনের সঙ্গী করেছিল। জামায়াতে ইসলামীরা কি তখন ‘রাজাকার’ ছিল না? আওয়ামি লিগের ভাষায় যে-এরশাদ ছিল তখন স্বৈরাচারী, তাকে কি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পর্যন্ত বানানো হয়নি? জনগণ কী করে ভুলবে যে এই স্বৈরাচারীরই পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল আওয়ামি সরকার? বাঙালি ও বাউল সংস্কৃতিকে সংকুচিত করা হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলেই সবচেয়ে বেশি। কেন ‘পহেলা বৈশাখ’ উদ্যাপনের সময়সীমা নিরাপত্তার অজুহাতে নিরাপত্তা বাহিনী নির্ধারণ করে দিচ্ছে? কেন একের-পর-এক বাউল নানাভাবে মৌলবাদীদের হামলা ও হেনস্তার শিকার হন? এসবই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অংশ? এমনকী, পরিসংখ্যান বলছে, এক সময়ের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে পরিচিত হিন্দুদের উপর নিপীড়ন ও জমি দখল গত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের আমলেই বেশি হয়েছে। কমতে-কমতে ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে আসায় হিন্দুরা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক নয় এবং সুষ্ঠু ভোটব্যবস্থা না-থাকায় খোদ ভোটব্যাঙ্কের হিসাবও গুরুত্বহীন, অতএব, তাদের উপর নিপীড়নে আওয়ামী লীগের কীই-বা আসে যায়! অভিযোগ উঠছে– এই দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে মৌলবাদের উপাদানে যতটা আচ্ছন্ন করা হয়েছে, তার জন্য আওয়ামী লীগের অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডই সবচেয়ে বেশি দায়ী! জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থান কোনওভাবেই এত বড় হওয়ার কথা ছিল না। এতটা যে বড় হতে পারল– তার নেপথ্যে উপরোক্ত সব কারণই সমন্বিত হয়ে বিস্ফোরক রূপ ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের প্রতি রাজনৈতিক অনাস্থা ও গণ-হতাশার চূড়ান্ত প্রকাশ এই গণ-বিক্ষোভ। আর, আশ্চর্য এই যে, প্রশাসনিক প্রধান মুখে যদিও বারবার বলেছেন, দুর্নীতি তিনি মোটেই সহ্য করবেন না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সরকারি বড়-বড় দুর্নীতিবাজ চাকুরিরত অবস্থায় গোয়েন্দা বিভাগকে কাঁচকলা দেখিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে– আর, তথ্য ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকী, তদন্ত চলার কালেই দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছে। এসবই এ-সরকারের ভাবমূর্তিকে ভয়ানকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে আর মানুষকে করেছে ক্ষুব্ধ।
গত ১৫ বছরে যে-তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তা নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে কেবল প্রতারণাই নয়, রীতিমতো জনগণকে অপমান করাও। মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে এভাবে বঞ্চিত করে নির্বাচিত হওয়া যায় বশংবদ প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায়, কিন্তু আওয়ামী লীগ যে গণ-বিচ্ছিন্নতার এই চর্চা করে গণ-বিরাগভাজন হয়ে উঠেছে, সেটাকে তারা মোটেই গ্রাহ্য করেনি। জনসমর্থনের তোয়াক্কা না-করে এই নিরন্তর ক্ষমতারোহণ তাদেরকে নিয়ে গিয়েছে অসহিষ্ণুতা ও বেপরোয়ামির পরাকাষ্ঠায়। তার পরিণতিও আমরা দেখলাম।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক