হইচইয়ে ৫ জুলাই মুক্তি পাবে নতুন সিরিজ 'বিজয়া'। সিরিজের মুক্তির আগে অকপট স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
নতুন সিরিজ ‘বিজয়া’-র টিজার দেখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে, স্বপ্নদীপ কুণ্ডু-র অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। এই সিরিজ কতটা ফ্যাক্ট, কতটা ফিকশন?
স্বস্তিকা: সিরিজটা দেখলে যে শিক্ষাকেন্দ্রে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা মনে পড়বেই। ওয়ান লাইনার শুনেও আমার সেটাই মনে পড়েছিল। ‘বিজয়া’ একজন মায়ের লড়াই, তার সন্তানের প্রতি জাস্টিস চায়। তবে জাস্টিস একটা বড় ‘শব্দ’। অর্ধেক সময়ে ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল সেটাই জানা যায় না। কারণ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রতিটা স্তরে লোকে মিথে্য কথা বলে। অনেক সময় দুদিনের মধে্য তদন্ত করে বলে দেওয়া হয়, কেস ক্লোজড। মফস্সল থেকে আসা বাবা-মা কোন-কোন দরজায় কড়া নাড়বে? আসলে কী ঘটেছিল সেটা জানতে চাওয়া নিয়ে যুদ্ধটা শুরু হয়, তারপর তো সাপের গর্তের বাইরে অপেক্ষা করা।
আপনাকে যখন এই সিরিজটা অফার করা হয়, প্রথম প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
স্বস্তিকা: প্রথমেই মনে হয়েছিল, এই সিরিজটা আমি করতে চাই। আমাদের সমাজে হয়ে চলা এমন নানা পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে যদি আমাদের সোচ্চার হওয়ার কথা ওঠে, তাহলে একজন শিল্পী হিসাবে কীভাবে সোচ্চার হতে পারি! প্রতিবাদটা শুধু ফেসবুকে করলে তো চলবে না। আরও বৃহত্তর স্তরে করা উচিত। এবং আমি সেটা আমার কাজ দিয়েই করতে পারি।
এটা যথেষ্ট সাহসী চরিত্র....
স্বস্তিকা: একজন মহিলা বিকিনি পরে অভিনয় করলে তখনই আমরা ‘বোল্ড’ শব্দটা ব্যবহার করি। এই শব্দের আসল মানেটাই হারিয়ে গিয়েছে এই অপব্যবহারে। এই ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘হইচই’ যে এমন একটা সিরিজের কথা ভেবেছে, সেটাই সাহসিকতার পরিচয় দেয়। মফসস্ল থেকে আসা সন্তানহারা একজন মা অসহায় হয়েও কতটা নির্ভীক হয়ে উঠতে পারে সেটা আছে এই সিরিজে। আমার আর কেউ নেই, কিছু হারানোর নেই– এটাও একটা জোরের জায়গা হতে পারে।
ব্যক্তিগত জীবনে, আপনার এই অনুভূতিটা কখনও হয়েছে যে, আমার আর কেউ নেই?
স্বস্তিকা: মা এবং বাবা চলে যাওয়ার পর মেয়ে যখন বাইরে পড়তে চলে গেল ২০২১-২০২২-এ তখন আমার প্রথম তিন-চারটে মাস যে কীভাবে কেটেছিল বোঝাতে পারব না। এখন পিছনে তাকালে ওই সময়টা মনে পড়লে আমার ভয় লাগে। থেরাপিতে গিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি– কারণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না যে আমাকে এত বড় বাড়িতে একা থাকতে হবে। সব সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকেছি, কোনওদিন বাইরে পড়তে যাইনি, বাইরে চাকরি করিনি। জীবনে সত্যকে মেনে নেওয়ার যুদ্ধটাই সবচেয়ে কঠিন। অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার পর বাকিটা ম্যানেজ হয়ে যায়। একটা সময় ছিল, পাশের মানুষটার গায়ে হাতটা না রাখলে ঘুম আসত না। সেটা কোথায় পাব? মাসিকে বললাম, একসঙ্গে খাব, কিংবা আমার ঘরের কাছে ঘুমোও। বাড়িতে টিভি চালিয়ে রাখতাম, আলো জ্বালিয়ে রাখতাম। আর সেই আমি এখন বলতে পারি, একা থাকতে আমার ভালো লাগে। কবিতা পড়ি, গান শুনি, সিরিজ দেখি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই। এর মধে্যই খুব অদ্ভুতভাবে প্রায় বারো বছর পর শিলাজিতের সঙ্গে আমার দেখা হল।
সেটা কীভাবে হল? আপনাদের পরিচয় তো অনেক দিনের?
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, আমার যখন বাইশ-তেইশ সেই সময়ে আমাদের বন্ধুত্ব। ছোটবেলার ক্রাশ যেমন হয়। ওর পাড়ায় শুটিং করছিলাম। ফোন করায় চলে এল। বারো বছর পর দেখা কিন্তু মনে-মনে অবাক হলাম, কারণ মনে হল, এই যেন গত পরশুও আড্ডা মেরেছি। যেখানে ঠিক গল্পটা শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই যেন আমরা আড্ডাটা শুরু করলাম।
আপনার, শিলাজিতের গান শোনার ভিডিও দেখলাম।
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, আমরা আড্ডা মেরেছি, গান শুনেছি। প্রচুর জমে থাকা কথা হল। সমাজ-স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরে কোনও সম্পর্ক দেখলেই লোকে নানা কথা বলে। তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আজ পিছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি, এই যে লোকের কথায় কিছু এসে না যাওয়া, জাজমেন্টাল না হওয়া– এটার অনেকটাই আমার ওর থেকে পাওয়া। এই দীর্ঘ বারো-চোদ্দো বছর পর দেখা হয়ে একটা উপলব্ধি হল যে– আমরা অনেক সময়ই বুঝি না, কোন মানুষ কীভাবে কখন ইন্সপায়ার করে গিয়েছে।
আপনার বলতে দ্বিধা নেই!
স্বস্তিকা: না, নেই। ভেবে দেখো আমাদের যখন সমালোচনা করার থাকে, কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলার থাকে তখন, সেটা কিন্তু আমরা গলা ফাটিয়ে বলি। কিন্তু কারও প্রতি যদি আমাদের ভালোবাসা থাকে, ভালোলাগা থাকে, প্রশংসাসূচক কিছু বলার থাকে তখন যেন আমাদের কত লজ্জা, আমরা সামনাসামনি, সরাসরি সেটা বলি না।
আজকের পৃথিবী ঘৃণার প্রচার করতে বেশি ভালোবাসে, ভালোবাসার আর শান্তির বার্তা দিতে স্বচ্ছন্দ নয়!
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, তাই হবে বোধহয়। আসলে এত কথা বলে যেটা বোঝাতে চাইছি, আমার আশপাশের মানুষ বা অভিনীত চরিত্রদের মধে্য যখন আমি আমার কিছু দিতে পারব, বা তাদের থেকে কিছু নিয়ে সমৃদ্ধ হব– এই অাদান-প্রদানটা না হলে কোনও কিছুই বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু থাকে না। আমার ভালনারেবিলিটি এবং দুর্বলতম জায়গা থেকেও যে সাহস পাওয়া যায় সেটা আমি যেমন পেয়েছি, ‘বিজয়া’-ও পেয়েছে। তবে আরও বড় মাত্রায় এসেছে। মা হিসাবে সেটার সঙ্গে আমি খুবই একাত্মবোধ করেছি।
এই চরিত্রটার জন্য আলাদা কিছু করতে হয়েছে?
স্বস্তিকা: যাতে বিশ্বাসযোগ্য লাগে তার জন্য একেবারে মেকআপ করিনি। ‘বিজয়া’ নৈহাটি থেকে আসা খুব সাধারণ গৃহবধূ। গায়ে আঁচল দিয়ে সাদা শাড়ি পরেছি। হাঁটাচলার মধ্যে শহুরে ভাব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। উচ্চারণে কিছু হেরফের করেছি।
সেলিব্রিটিদের নানা সময়ে সমাজে ঘটে চলা নানা ঘটনা নিয়ে মত প্রকাশের একটা চাপ থাকে। যতদূর মনে পড়ে,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপ্নদীপের মৃত্যুর সময় আপনি সরব হননি...
স্বস্তিকা: এই যে সরব হওয়ার কথা বলছ, আমি কোথায় মুখটা খুলব! সমস্ত প্রতিবাদ ফেসবুকে কী করে করব! একে তো আমার নিজের ইউনিভার্সিটি, আমি যদি কিছু বলতাম, সেটা নিয়ে এমন একটা ভাইরাল ইসু্য হয়ে সমস্ত ফোকাস সেই কথার দিকে চলে যেত, আসল ঘটনার থেকে, সেটা কাম্য নয়। সেটা করার থেকে এমন কাজ করার সুযোগ পেলাম, যেখানে আমিই যেন সেই ছেলেটির অভিভাবক হয়ে কথা বলছি। যেমন ‘কমলিনী’-র চরিত্রের মধ্য দিয়ে অনেক উচিত কথা বলতে পেরেছি সমাজের হিপোক্রিসি নিয়ে। সে আনঅ্যাপোলোজেটিক। নিজের প্রোফেশনাল চয়েস নিয়ে ওর কোনও অস্বস্তি ছিল না। নিজেকে সে এসকর্ট বলতে লজ্জা পায়নি। যদি কেউ ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে অপমান করার জন্য বেশ্যা বললে আমি কুঁকড়ে যাব, তাহলে ভুল করবে। আমি মাথা উঁচু করে বলব, আমার ওদের স্টাইল স্টেটমেন্ট ভালো লাগে, খুব ভালো বলেছেন। আমার খুব মজা লাগে এটা ভাবতে যে, সমাজ ভাবে মেয়েদের বেশ্যা বলা মানে সর্বোচ্চ অপমান করা! (হাসি)! যখন আমার কাছে এমন সাহসী, আনঅ্যাপোলোজেটিক চরিত্র আসে, তখন তাদের বলি, পরে চাপে পড়ে চরিত্রটাকে যদি সরি চাইতে বলো, আমি কিন্তু করব না।
এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটা রিপোর্ট পড়লাম, যেখানে স্বপ্নদীপের বাবার, নিঃসঙ্গ আইনি লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থার জাস্টিস পেতে অনেকটা সময় লাগে।
স্বস্তিকা: আমাদের দেশে আপদ-বিপদে লোকে বলে, কেস করে দাও, তারপর কীভাবে কী হবে সেটা কেউ ভাবে না। আমরা কি কেউ জানি স্বপ্নদীপের বাবার পরিস্থিতি কী? আইনি লড়াই কোন অবস্থায় আছে? তাদের কেউ সাহায্য করছে কি না? এটা একটা সারা জীবনের যুদ্ধ। আমাদের দেশের জুডিশিয়াল সিস্টেম এতটা সময় নিয়ে নেয়– সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। পুত্রশোকের দুঃখটাই হয়তো পিছনে চলে গিয়েছে, আইনি যুদ্ধটাই এখন হয়তো ফোরফ্রন্টে– কে জানে!
‘বিজয়া’ মুক্তি পাবে ৫ জুলাই। স্বপ্নদীপ মারা যায় গত বছর আগস্টে। প্রায় এক বছরের মাথায়। আশা করি মানুষের আরেকবার মনে পড়বে?
স্বস্তিকা: আমাদের অ্যাটেনশন স্প্যান কমে গিয়ে হয়েছে রিলের বারো সেকেন্ডে। ফলে গত বছরের ঘটনা এখন পিছনে চলে গিয়েছে। সেখানে যদি মানুষকে মনে করাতে হয়, ভিস্যুয়াল মিডিয়ার চেয়ে বেটার কীই বা হতে পারে। যতবার ‘বিজয়া’(Bijoya) -র প্রসঙ্গ উঠবে ততবার স্বপ্নদীপের মৃতু্যর ঘটনাটা মনে পড়বে। সিরিজ নিয়ে ভালো বলুক, খারাপ বলুক, আমার অভিনয় ভালো, মন্দ বা খারাপ বলুক, প্রসঙ্গটা উঠবেই। এবং সেটা বারবার ওঠা দরকার।