কর্মজগতে নারীর নির্যাতন, টলিউডে পরিবেশ বদলের প্রয়াস এবং তাঁর অভিনীত নতুন ছবি 'টেক্কা' নিয়ে সাক্ষাৎকারে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় (Swastika Mukherjee)। মুখোমুখি বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
আন্দোলন এবং কাজ দুটোই পাশাপাশি চলতে পারে। তবু আপনার কি মনে হয় না অভিনেতারা ট্রোলদের সফট টার্গেট হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। বিশেষ করে মহিলাদের অনেক বেশি ট্রোল করা হচ্ছে।
- আসলে মানুষ আমাদের সং মনে করেন। তবে একটা কথা বলতে চাই, যে সব সাধারণ মানুষ পথে নেমে কিংবা না নেমে এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা কিন্তু ততটাও আক্রমণাত্মক নন। আমি এর মধ্যে অনেকটা সময় রাস্তায়-রাস্তায় কাটিয়েছি। আমি মানুষের মধ্যে সেই সহমর্মিতা দেখেছি। বরং যাদের এই আন্দোলন নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তারা অনেক বেশি ট্রোল করে। হঠাৎ সকালে উঠে হয়তো ঠিক করলেন, আজকে অমুককে টার্গেট করা হবে। আমি এত ট্রোলড হয়েছি যে, এটা নিয়ে আমার নতুন কিছু বলার নেই। এবং এটাও সবাই জানে প্রতিটি পলিটিক্যাল পার্টির আইটি সেল এটা নিয়ে কাজ করে। তবে এর আগে হয়তো আমাকে ট্রোল করলে পাশে পঞ্চাশজন মহিলার সাপোর্ট পেতাম এখন ৫০০ জনের সাপোর্ট পাচ্ছি। এটা অভাবনীয়। যাঁরা ট্রোল করেন তাঁরা ভুলে যান, সাধারণের কাছে যেটা বিনোদন সেটা আমার পেশা, আমার রুজি-রোজগার।
তবে একটা কথা বলুন এবারে 'টেক্কা'র প্রোমোশন নিয়ে এক্সাইটমেন্ট কি একটু কম?
- এক্সাইটমেন্ট একেবারেই নেই। কিন্তু এটা আমার কাজ। ছবির প্রোমোশনে গিয়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে, কথা বলতে হবে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা ছবিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন প্রোডিউসার। সেটা তো ছেলেখেলা নয়। বরং যখন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ছবির শুটিং হচ্ছিল, তখন দারুণ এক্সাইটেড ছিলাম।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘টেক্কা’, দেবের প্রোডাকশন- সেই জন্যই কি রাজি হলেন?
- ২০২২ সালে আমাকে সৃজিত স্ক্রিপ্টটা শুনিয়েছিল। আমার গল্পটা তখনই ভালো লেগেছিল। এই ছবি ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অবলম্বন করে তৈরি হয়েছে...
ও আচ্ছা, আসলে ‘টেক্কা’র স্টোরি লাইন শুনে ২০১৬ সালে নিশিকান্ত কামাথ পরিচালিত ছবি ‘মাদারি’র প্লটের সঙ্গে খানিক মিল পেয়েছি।
- না না, একেবারেই নয়। এটা ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়ের লেখা অবলন্বনে তৈরি। হ্যাঁ বলার কারণ ওই যে বললাম, গল্প এবং প্রেক্ষাপট দারুণ লেগেছিল। ৪৮ ঘণ্টার হোস্টেজ ড্রামা বাংলায় খুব একটা দেখিনি। তার ওপর সৃজিতের সঙ্গে ছয় বছর পর কাজ করার সুযোগ, দেবের প্রোডাকশনে প্রথম কাজ, রুক্মিণীর সঙ্গে প্রথম স্ক্রিন শেয়ার। সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের জীবন নিয়ে এমন একটা ন্যারেটিভ হতে পারে ভাবাই যায় না। একটি হাই রাইজের জমাদারের চরিত্রে দেব নিজেকে অনেকটাই ভেঙেছে। ওর সুপারস্টার ইমেজের কথা তোয়াক্কা না করে এই ছবিতে দারুণ রিস্ক নিয়েছে।
শুনেছি আপনার নাকি রুক্মিণীর চরিত্রটা করার কথা ছিল।
- হুমম..., এই ছবিতে দুই নারী। যারা ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করে। স্টেটাস আলাদা। আবার মহিলা বলেই বোধহয় কোথায় একটা একসুতোয় বাঁধা। এটা ঠিক যে, আমাকে আগে পুলিশের চরিত্রটা অফার করা হয়েছিল কিন্তু আমি অলরেডি ‘নিখোঁজ’ ওয়েব সিরিজে তেমন চরিত্রে অভিনয় করেছি। তবে এটাও ঠিক আমি এর আগে মায়ের চরিত্রেও অভিনয় করেছি। ‘টেক্কা’য় আমি যে মায়ের চরিত্রে সেটা অন্য মায়েদের থেকে আলাদা হলেও কোথাও আবার এক। তবে আরেকটা কারণ হল ‘টেক্কা’-র শুটিংয়ের তিন-চার মাস আগে আমার একটা বড় সার্জারি হয়। এবং তার পর শারীরিক ভাবে ততটাও ফিট ছিলাম না। শরীরে একটা ভারী ব্যাপার চলে এসেছিল। ভিস্যুয়ালি রুক্মিণী লুকড দ্য পার্ট। এবং ও নিজের জায়গা থেকে পুলিশের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছে। ‘এই রোলটা ও কেন করল, আমি করলে আরও ভালো হত’– এই ধরনের ব্যক্তিগত লড়াইয়ের দিন ফুরিয়েছে। এখন সহকর্মীদের মধ্যে যে যাতে ভালো, সর্বসমক্ষে তাকে প্রশংসা করার সময় এসেছে।
সৃজিতের সঙ্গে অনেকদিন পর কাজ করলেন। পরিচালক হিসাবে কতটা বদলেছেন?
- এখন অনেকটা ঠান্ডা হয়েছে। বয়স হয়েছে তো! বেশ কিছু দৃশ্যে দেখলাম নিজেই ক্যামেরা করছে, তার মানে টেকনিক্যালি স্ট্রং হয়েছে। ও এখন বড় ক্যানভাসের ছবি ভালোই সামলাতে পারে। তবে এখনও আগেরই মতো হাড় জ্বালিয়েছে। হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এক্কেবারে মাস্টার।
আর জি কর-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা তরঙ্গ উঠেছে। টলিউডেও একের পর এক নিগ্রহের ঘটনা উঠে আসছে। কী মনে হয় আরও অনেক অভিনেত্রীরা তাঁদের নিজেদের কথা বলবেন? দোষীরা শাস্তি পাবে?
- সেই জন্যই ‘উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়র্কার প্লাস’ নিয়ে জোরকদমে কাজ চালাচ্ছি। আমরা নিজেদের জন্য সেফ স্পেস তৈরি করার চেষ্টা করছি যেখানে মেয়েরা কমপ্লেন করতে এগিয়ে আসতে পারে, কে কী ভাববে বা বলবে এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে। ওয়র্ক স্পেসে হ্যারাসমেন্ট নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরেই লড়াই করছি নিজেদের মতো। এর আগেও অভিযোগ নিয়ে আসত, তারপর সব হাওয়া হয়ে যেত। এবার আর হ্যারাসমেন্টের খবর উবে যেতে দেব না। ‘অরিন্দম শীল’ মার্কা লোকেরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে ধামাচাপা দিয়ে দিতে পারবে না। ইন্ডাস্ট্রির এই অন্ধকার দিক সম্পর্কে সবাই কিন্তু জানে। এটা একদম ভুল কথা যে এর মধ্যে যখন কমপ্লেন লজ হল তখন সবাই প্রথম জানতে পারল এবং যেন সকলের ঘুম ভাঙল। এ সব নিয়ে পিছনে সবাই আলোচনা করে।
[আরও পড়ুন: ‘এবার মা দুর্গার কাছে শুধু শক্তি চাইব’, পুজো পরিকল্পনা জানালেন মধুমিতা]
তার মানে হ্যারাসমেন্ট-এর খবর যথেষ্ট রিপোর্টেড হত না।
- শুধু তাই নয়, মেয়েরা যে সামনে এসে কথা বলবে সেই সাহস পেত না। আর এই খবরগুলো হাওয়া হয়ে যেত। ফলো আপ ছিল না। ক্ষমতা প্রয়োগ করে মিডিয়াকে সামলে নিত। কেউ গা করত না এবং এই ধরনের হেনস্তাকারীদের মাথায় তুলে নাচানাচি করত। যারা কমপ্লেন করত তাদের কাজ দেওয়া বন্ধ করে দিত। যেখানে আমি হেনস্তা হয়েছি সেখানে আমার লজ্জা পাওয়ার এবং আমার কাজের ক্ষতি হওয়ার তো কথা নয়। ‘এনএবিসি’-তে গিয়েও দেখেছি। অভিযুক্ত পরিচালককে সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছে। আমার তো চব্বিশ বছরের কেরিয়ার। যখন ‘এক আকাশের নীচে’ করতাম, তখন থেকে দেখেছি মেয়েরা অরিন্দম শীলের এগেনস্টে কমপ্লেন করছে। তখন আমার বাইশ-তেইশ বছর বয়স। তো কুড়ি-বাইশ বছর ধরে মহিলারা কমপ্লেন করে যাচ্ছে, কারও টনক নড়ল না! এখন সময় এসেছে। এখন আর বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হবে না। এখন একটা মেয়ের সঙ্গে কিছু হলে আমরা পঞ্চাশটা মেয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াব। বা আমরা পঞ্চাশটা মেয়ে বলব যে আমরা অভিযুক্তর সঙ্গে কাজ করব না। না হলে শিক্ষা দেওয়া যাবে না। এই পরিস্থিতিটাই বদলানোর চেষ্টা করছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমাদের কাজ চলছে।
আপনি নিজে হ্যারাসড হয়েছেন? আগামী দিনে কিছু বদলাবে?
- কাজের জায়গায় আমিও হ্যারাসড হয়েছি। এমন কোনও মহিলা আছে বলে তো আমার জানা নেই যে হ্যারাসড হয়নি। হ্যারাসড হয়ে সোচ্চারও হয়েছি এবং তার জন্য কাজের ক্ষতি হয়েছে এমনও হয়েছে। অন্যদের সঙ্গেও হয়েছে। এখন সবাই একজায়গায় হওয়ার ফলে জানতে পারছি। আগামী দিনে কর্মজগতে একটা সুস্থ পরিবর্তন আনতে হবে। কেবল যৌন হয়রানি নির্মূল নয়, কাজের জায়গায় পরিকাঠামোগত
পরিবর্তন চাই। যেখানে মেয়েরা ১৪ ঘণ্টা কাজ করে সেখানে প্রপার বাথরুম পর্যন্ত নেই। এই বেসিক জায়গা থেকে লড়াইটা শুরু করতে হচ্ছে। বাংলা সিনেমার ১০০ বছর পার হওয়ার পর ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে এই জাগরণ হচ্ছে। অনেকটা সময় লেগে গেল।