আকাশ মিশ্র: যেকোনও বায়োপিক তৈরি করার সময়, পরিচালকের কাঁধে একটা গুরুদায়িত্ব থাকে। যাঁর জীবনকে পর্দায় তুলে ধরা হচ্ছে, তাঁর জীবনের সবচেয়ে লড়াকু অধ্যায়কে সুন্দর করে তুলে ধরা চেষ্টা কিংবা ভালো-খারাপ মেশানো জীবনকে দুই পাল্লায় রেখে ছবির গল্প এগিয়ে নিয়ে চলা। তবে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের বায়োপিকের ক্ষেত্রে এই সমতা বা বিতর্কের মাত্রা রাখাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল পরিচালক ও অভিনেতা রণদীপ হুড্ডার ক্ষেত্রে। কেননা, ছবি তৈরির সময় তাঁর হাতে যে তথ্যগুলোই এসেছে তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে। আসলে, এদেশে স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম বিতর্কিত নামই হল বিনায়ক দামোদর সাভারকর। আর বিতর্ক মানেই একটু সাবধানে এগিয়ে চলা।
এমনিতেই দেশজুড়ে এখন ভোটের হাওয়া। গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের একশ্রেণির মানুষের স্লোগানে শুধুই ‘হিন্দুত্ববাদ’। ঠিক এই সময়ই সাভারকরের বায়োপিক পর্দায় আনলে যে বক্স অফিস জিতে নেওয়া যাবে, সেটা আন্দাজ করেই ছবি তৈরির মাঠে নেমেছিলেন রণদীপ হুডা। তা কিন্তু বেশ স্পষ্ট ছবির প্রতিটা ফ্রেমে। সেই উদ্দেশ্যেও সফল। কেননা, ছবিতে রণদীপের মুখে হিন্দুত্ববাদের জয়গান শুনলেই, সিনেমাহলে হাততালি। আর এখানেই বায়োপিকে নিয়ম ভাঙলেন পরিচালক রণদীপ হুডা। সাভারকরের জীবনের গল্প ঢাকা-চাপা পড়ে গেল ভোটের আগের প্রোপাগান্ডায়।
সাভারকর আসলে কে? ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা, নাকি ইংরেজ শাসকের কাছে নিরন্তর ক্ষমাপ্রার্থনা করে মুক্তি পাওয়া সাম্রাজ্যবাদের এক গোপন বন্ধু? গান্ধীহত্যার নেপথ্য কুশীলব? নাকি হিন্দুদের মসিহা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু আজও স্পষ্ট নয়। ভারতীয় ইতিহাসবিদরাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারেননি। অনেকেই মনে করেন সাভারকার আসলে কিছুটা উপেক্ষিত। তাঁর সম্বন্ধে যা শোনা যায়, সবই যেন অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। এখনও অবধি তাঁর কোনও প্রামাণিক জীবনী নেই। সেক্ষেত্রে ছবি তৈরির সময় রণদীপ হুডার রিসার্চের জন্য হাতে পেয়েছিলেন সংবাদের শিরোনাম, কাগজের কাটিং। নানা বইয়ে ছড়িয়ে থাকা সাভারকরের জীবনকে হাতের মুঠোয় এনে পর্দায় পরিবেশন করলেন। যার ফলে সাভারকরের প্রধান পরিচিতি হয়ে দাঁড়াল ‘হিন্দুত্বের জনক’।
[আরও পড়ুন: বাঁদরে নিল মিমির সানগ্লাস, কীভাবে ফেরত পেলেন? দেখুন ভিডিও ]
গত কয়েক বছরের বলিউড সিনেমার ইতিহাসের দিকে নজর রাখলে দেখা যায়, পাক-ভারত যুদ্ধ কিংবা ‘ দ্য কাশ্মীর ফাইলস’, ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র মতো ছবি। যেখানে ছবির গল্পে প্রকট হয়ে ওঠে হিন্দুত্ববাদ, বিশেষ করে ইসলামোফোবিয়া। রণদীপ, সাভারকরের বায়োপিক তৈরি করতে গিয়েও, এই অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে পারলেন না। সাভারকরের জীবনকে যদি শুধু দেখাতেন তাহলে হয়তো কোথাও গিয়ে, ছবি হিসেবে বা পরিচালক হিসেবে রণদীপ হুডাকে গুরুত্ব দেওয়া যেত। কিন্তু সে জায়গায় রণদীপ হেরেই গেলেন।
পরিচালক হিসেবে হেরে গেলেও, অভিনেতা হিসেবে রণদীপ একশোতে একশো। শুধু চেহারা ভেঙেচুড়ে সাভারকরের অবতারে নিজেকে তুলে ধরা নয়। প্রতিটা ফ্রেমেই দুরন্ত রণদীপ। বিশেষ করে কালাপানির সময়ের অভিনয় দাগ কেটে যায়।
‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকর’ এমন এক ছবি যা সাভারকরের জীবনকে কম বরং গেরুয়া রাজনীতিকেই বেশি প্রভাবিত। এই ছবি এমন এক ছবি যা কিনা লজিক ছাড়াই হিন্দুত্ববাদের কথা বলে। রণদীপ হুডার দুরন্ত অভিনয়ের জন্যই এই ছবি দেখা যায়। তাছাড়া, ‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকর’ বায়োপিকের নামে প্রোপাগান্ডা ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়।