সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শ্মশান শব্দটা উচ্চারণ করতেও অনেকের গা ছমছম করে! কেন না, শ্মশান যে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় পৃথিবীর সব চেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবের কাছে। যাঁরাই শ্মশানে গিয়েছেন, স্পষ্ট করে বুঝেছেন, মৃত্যু কাউকে রেয়াত করে না। একদিন সে যখন ডাক দেবে, তখন সযত্নে রক্ষা করা অহং বা শরীর- সবটাই চলে যাবে বৃথার খাতে! তখন পাশে পড়ে থাকা একটা মৃতদেহর সঙ্গে অন্যগুলোর কোনও তফাত নেই! তখন তারা হেলাফেলার, দাহতে কর্তব্যপালনের মাধ্যম মাত্র!
তবে, তারাপীঠের শ্মশানকে দেখতে হবে একটু অন্য চোখে। যে কারণে একে বলা হয় মহাশ্মশান। এই মহাশ্মশানেই জীবন আর মৃত্যুর পটভূমি নিত্য রচনা করে চলেন দেবী তারা।
তারাপীঠের মহাশ্মশানের মাহাত্ম্য বুঝতে গেলে তাকাতে হবে তারার তন্ত্রোক্ত রূপবর্ণনায়। তন্ত্রে তারাকে বলা হয়েছে দ্বিতীয় মহাবিদ্যা। এই দ্বিতীয় মহাবিদ্যা দেবী তারা শায়িত শিবের বক্ষে দণ্ডায়মানা। দেবীর বামপদ অগ্রগামী, তাই দেবী ‘বামাকালী’ নামেও পরিচিতা। দেবীর গাত্রবর্ণ ঘননীল। অগ্নিময় শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার মধ্য থেকে বিনির্গতা এই দেবী লোলজিহ্বা, লম্বোদরী, নবযৌবনা এবং মুণ্ডমালিনী। দেবীর আসনস্বরূপ জ্বলন্ত চিতা জ্ঞানাগ্নির প্রতীক। চতুর্ভুজা এই দেবীর ডানদিকের উপরের হাতে খড়্গ এবং নিচের হাতে কাটারি। বামদিকের উপরের হাতে পদ্মফুল এবং নিচের হাতে নরকপাল। দেবীর কটিদেশ ব্যাঘ্রচর্মে আবৃত। দেবীর মস্তকে ‘পঞ্চমুদ্রাবিভুষিত’ পিঙ্গলবর্ণের একজটা। ‘পঞ্চমুদ্রা’ অর্থাৎ শ্বেত অস্থি নির্মিত চারটি পটি দিয়ে ত্রিকোণাকারে গাঁথা পাঁচটি নরকরোটি। মু্ণ্ড জ্ঞানের প্রতীক। এখানে পঞ্চমুণ্ড শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধের প্রতীক। দেবীর জটাশীর্ষে রয়েছেন ‘অক্ষোভ্য’, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা ব্রহ্মশক্তির প্রতীক স্ত্রী-নাগরূপী মহাদেব স্বয়ং। দেবীর সর্বাঙ্গ স্ত্রীসুলভ নাগ অলঙ্কারে ভূষিতা। দেবীর সর্বাঙ্গে সর্পালঙ্কার প্রকটিত বৈরাগ্যের প্রতীক। জীবকে ভবসাগর থেকে উদ্ধার করেন বলে তাঁকে তারিণী নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
এই রূপবর্ণনাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, শ্মশান দেবী তারার আবাস। তারাপীঠের মহাশ্মশানেও জ্যোতিরূপে বাস করেন দেবী। তা ঠিক যেন একটি তারার মিটমিটে আলো! দেবীর সঙ্গে থাকেন যোগিনীরা। অনেকেই তারাপীঠের মহাশ্মশানে অন্ধকারের মধ্যে এই মিটমিটে আলো দেখতে পান। লোকবিশ্বাস বলে, সেই আলো দেখে কাছে যেতে নেই। তাতে দেবী রুষ্টা হন! দেবীর উপস্থিতিই এই শ্মশানের তিন মহারহস্যের মধ্যে প্রথম।
তারাপীঠের মহাশ্মশানের দ্বিতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে শ্মশান-সংলগ্ন দ্বারকা নদীর জলে। এই নদী উত্তরবাহিনী। অর্থাৎ এর স্রোত বইছে উত্তর দিকে। হিন্দু ধর্মে উত্তরবাহিনী নদী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেন না, ভারতের প্রায় সব নদীই নেমেছে উত্তর দিকে স্থিত হিমালয় থেকে। অতএব, তাদের ধারা কখনই উত্তর অভিমুখী হবে না। হলে তা বইবে উল্টো খাতে। একমাত্র কাশীতে গঙ্গা উত্তরবাহিনী। আর বীরভূমে দ্বারকা। তাই দ্বারকা নদী মহাশক্তির উৎস। এই নদীজলে স্নান করলেই সিদ্ধিলাভের যোগ্যতা অর্জন করেন মানুষ। দূর হয় সব পাপ।
তৃতীয় রহস্য মহাশ্মশানস্থিত বামাখ্যাপার পঞ্চমুণ্ডের আসন। এই জায়গায় এসে একটু তাকাতে হবে দেবীর রূপবর্ণনায়। তাঁর মাথাতেও আমরা দেখছি পঞ্চমুণ্ডের সমাহার। কিন্তু, এই পঞ্চমুণ্ডের আসন আলাদা। এখানে পাঁচটি মুণ্ড সাপের, ব্যাঙের, খরগোশের, শিয়ালের এবং মানুষের। এই আসনে বসেই বহু যুগ পূর্বে দেবীকে তুষ্ট করে তারাপীঠকে সিদ্ধপীঠে পরিণত করেছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ। সেই আসন আজও বিদ্যমান। সাধক বামাখ্যাপাও এই আসনে বসে তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন। অর্থাৎ, এই আসন আজও জাগ্রত। খুব শুদ্ধচিত্তের মানুষ না হলে এই আসনে বসা মাত্র সারা শরীরে তীব্র জ্বালা শুরু হয়। সেই জ্বালায় উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ। অশুচি চিত্তে আসনে বসেছিল বসে শাস্তি পায়!
এই তিন মহারহস্য নিয়ে আজও বীরভূমের বুকে দণ্ডায়মান তারাপীঠের মহাশ্মশান। যা নিরন্তর বলে চলেছে দেবী তারার মাহাত্ম্য। বলে চলেছে এই জীবন নশ্বর।
The post তারাপীঠের মহাশ্মশানে লুকিয়ে আছে কোন তিন মহারহস্য? appeared first on Sangbad Pratidin.