শংকর ভট্টাচার্য: ফাটকা খেলেছিলেন। সফলও হলেন। তেলেঙ্গানায় সিকান্দার অবশ্যই কেসিআর। ফের ক্ষমতায় আসছে তাঁর নেতৃত্বাধীন তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা টিআরএস। নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই বিধানসভা ভেঙে দিয়ে বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন কে চন্দ্রশেখর রাও। সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ বলতে শুরু করেছিল, বড় ভুল হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর নিজের রাজ্যের রাজনৈতিক নাড়ি যে সব থেকে ভাল বোঝেন কেসিআর, তা ফের প্রমাণ হল। গত নির্বাচনের থেকেও বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে টিআরএস। দক্ষিণের ওই রাজ্যে মোট আসন ১১৯। তার মধ্যে গতবার টিআরএস পেয়েছিল ৬৩টি আসন। মোট ভোটের ৩৪ শতাংশ। এবার তা বাড়িয়ে হল ৮৮। উত্তর ভারতের তিন রাজ্যে কংগ্রেস ভাল ফল করলেও এই নয়া রাজ্যে তাদের ফল এত খারাপ কেন? কেন গত বারের ২৫ আসন থেকেও এবার নেমে আসতে হল? এই সব প্রশ্নই এখন হায়দরাবাদ থেকে ওয়ারাঙ্গল হয়ে খাম্মাম, মানুষের মুখে মুখে।
[মুখ্যমন্ত্রী কে? অন্তর্দ্বন্দ্বের আশঙ্কায় দুই রাজ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক কংগ্রেসের]
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, বিরোধী জোট বা মহাকুটমি’তে তেলুগু দেশমকে সঙ্গে নেওয়াই কাল হল কংগ্রেসের। কারণ, তেলেঙ্গানার অধিকাংশ এলাকায় এখনও তেলুগু দেশম অন্ধ্রের প্রতিনিধি। টিডিপি রাজ্য ভাগ চায়নি। ঐক্যবদ্ধ অন্ধ্রপ্রদেশের পক্ষে ছিল। অথচ কেন্দ্রে কংগ্রেস থাকার সময়েই এই রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত হয়। কার্যত জোর করেই সেই সময়ে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী পৃথক তেলেঙ্গানার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। ফলে অন্ধ্র এলাকায় কংগ্রেস ভিলেন হয়ে ওঠে। সেই তকমা এখনও বিজয়ওয়াড়া, ভাইজাগ বা নেল্লোরের মানুষ তেরঙ্গা পার্টিকে দিয়ে থাকেন। কিন্তু তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের এবার ভাল ফল না করার কোনও কারণ ছিল না। গত সাড়ে চার বছরে টিআরএস এবং রাজ্য সরকার কার্যত একটি পরিবারের হাতেই থেকে গিয়েছে। চন্দ্রশেখর রাওয়ের ছেলে কে টি রামা রাও, ভাগনে টি হরিশ রাও আর মেয়ে তথা সাংসদ কবিতাই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ফল লোকসভা ভোটের আগে গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের নির্বাচনে তেলেঙ্গানায় বিজেপির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। গত বছর এই রাজ্যে তারা পেয়েছিল পাঁচটি আসন। এবার তা কমে হল তিনটি। অন্যদিকে হায়দরাবাদ অঞ্চলের প্রধান শক্তি আল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনেরও শক্তি কমেছে। গত ভোটে তারা পেয়েছিল সাতটি আসন। এবার হয়েছে পাঁচটি। এবার বিরোধীদের জোট ‘মহাকুটমি’ বা মানুষের জোট নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল। সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, চন্দ্রবাবু নায়ডু-সহ তাবড় নেতারা প্রচারে নেমেছিলেন। ছিল সিপিআইও। কিন্ত জোট গড়েও ২১টি আসনের বেশি জুটল না তাঁদের। অথচ কংগ্রেস গত নির্বাচনে একাই পেয়েছিল ২৫ আসন। উত্তর তেলেঙ্গানায় টিআরএসের শক্তি ভাল। তুলনায় দক্ষিণে কংগ্রেস এবং টিডিপির শক্তি রয়েছে। তবে সমস্যা হল দক্ষিণে আসন মাত্র ৩১টি। আর উত্তরে ৫৪টি। সেই ‘ভাল’ জায়গা থেকেও বহু আসনে হারতে হয়েছে কংগ্রেসকে।
[রাজস্থানে পরাজিত ভারতের প্রথম গো-মন্ত্রী]
এবারের প্রচারে সুচারু রূপে সেই অন্ধ্র বনাম তেলেঙ্গানার সেন্টিমেন্ট খেলেছিলেন চন্দ্রশেখর রাও। বলা হয়েছিল, টিডিপি জিতলেই ফের ঐক্যবদ্ধ অন্ধ্র হয়ে যাবে। কংগ্রেস আবার পালটা অভিযোগ করেছিল, উপকূলের ঠিকাদারেরাই সুযোগ পাচ্ছে এই জমানাতেই। তাদের ব্যবসায় কোনও ভাটা পড়ে নি। ২০১৪-র ১ জুন রাত বারোটা পার হতেই নতুন রাজ্য হিসাবে তেলেঙ্গানা গঠিত হয়। ট্যাঙ্ক ব্যান্ড থেকে মুশিরাবাদ, সর্বত্রই স্লোগান ছিল ‘ইডলি দোসা ভাগো, তেলেঙ্গানা জাগো।’ চন্দ্রবাবুরা ছিলেন সেই ইডলি-দোসার প্রতীক। এবারও তাই লড়াইটা হয়ে দাঁড়াল চন্দ্রবাবু বনাম চন্দ্রশেখর রাওয়ের। এই লড়াইয়ে উপকূলের মানুষকে ঠেকাতে টিআরএসের পাশে বেশি করে দাঁড়িয়ে পড়লেন তেলেঙ্গানাবাসীরা। বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। আর তাই সব মিলিয়ে কেসিআরের ঝড়ই বয়ে গেল তেলেঙ্গানায়।