বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: কেন্দ্রীয় সরকারের চা নীতি কী? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত চা শিল্প রক্ষার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আদৌ কোনও পরিকল্পনা আছে কী?
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের বাজেট বক্তৃতা শোনার পর উত্তরের চা চাষি, চা শিল্পপতি এবং শ্রমিক নেতৃত্বের মধ্যে ওই প্রশ্ন উঠেছে। একমাস আগে থেকে বিপন্ন চা শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে কেন্দ্রীয় অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রকে গুচ্ছধরা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তাঁরা। সে সব তো বটেই, কেন্দ্রীয় বাজেটে বিপন্ন চা শিল্পেরই নামগন্ধ নেই। অথচ এই শিল্পে জড়িয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকা। উত্তরের অর্থনীতির অনেকটা। স্বভাবতই বেড়েছে হতাশা। অভিযোগ উঠেছে বঞ্চনার। কেন উঠবে না? চা বণিকসভাগুলো সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর থেকে একদিকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা। অন্যদিকে বাজারে দামের ওঠানামার ধাক্কায় বিপর্যস্ত উত্তরের চা শিল্প।
[আরও পড়ুন: বাজেটে বেতনভুক কর্মীদের আয়কর স্বস্তি, নতুন কর কাঠামোয় বদল]
গত অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সাত মাস বৃষ্টি ছিল না। তীব্র তাপদহের জেরে মার্চ মাস পর্যন্ত রাজ্যে চা উৎপাদনে প্রায় ছয় মিলিয়ন কেজি ঘাটতি হয়। মে মাস থেকে ঘাটতি বেড়েছে শুধু নয়। চা বাগান রক্ষাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেচ দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। ৮০ শতাংশ ছোট চা বাগান তাপদাহে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাছ শুকিয়ে মরেছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি। এর পর প্রবল বৃষ্টির জন্য উৎপাদন কমে। লোকসান বাড়ে। জানা গিয়েছে, আবহাওয়ার খামখেয়ালির জন্য এবার মে মাস পর্যন্ত ২০ মিলিয়ন কেজি কম চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। জুন, জুলাই মাসেও উৎপাদন মার খেয়েছে।
দার্জিলিংয়ে চা শিল্পপতি সতীশ মিত্রুকা বলেন, "উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিছুতেই সামলে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই নিরুপায় হয়ে চা বাগান বিক্রি করার কথা ভাবছেন। বুঝতে পারছি না এই সরকারের চা নীতি কী।" তিনি জানান, পরিস্থিতি মোকাবিলার একমাস আগে থেকে কেন্দ্রীয় বানিজ্য ও অর্থমন্ত্রকে প্রচুর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বাজেটে চা শিল্প নিয়ে একটি শব্দ না থাকায় তারা হতাশ। সতীশবাবু অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকার যে চা শিল্প নিয়ে উদাসীন সেটা বাজেট থেকেই স্পষ্ট। নর্থ বেঙ্গল টি প্রোডিউসার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সঞ্জয়কুমার আগরওয়াল জানান, বছরে ২২ মিলিয়ন কেজি নেপালের নিম্নমানের চা বাণিজ্য শুল্ক ছাড়াই উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্যের বাজারে ঢুকে দার্জিলিং চায়ের সুনাম নষ্ট করছে। সেকথা কেন্দ্রীয় সরকারকে বার বার জানানোর পরও ব্যবস্থা নেয়নি। বাজেটেও দিশা নেই।
[আরও পড়ুন: অশান্ত বাংলাদেশ থেকে দলে দলে ফিরছেন ভারতীয় পড়ুয়ারা, কী পড়তে যান তাঁরা?]
চা বণিকসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তরের পাহাড়-সমতলে বড় চা বাগান রয়েছে ৩১১টি। তার মধ্যে ডুয়ার্সে ১৭৮টি, তরাইয়ে ৪৬টি এবং পাহাড়ে ৮৭টি। এর বাইরে উত্তরের ইসলামপুর থেকে মেখলিগঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় রয়েছে ৫০ হাজার ছোট চা বাগান। অন্তত ১৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চা শিল্পের উপর নির্ভরশীল। চা শিল্পপতি পুরণজিত বক্সি গুপ্ত বলেন, "আবহাওয়ার পরিবর্তনের জেরে কয়েক বছর থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরের চা শিল্প। আমরা আশা করেছিলাম কেন্দ্রীয় বাজেটে পরিস্থিতি মোকাবিলার পথ দেখাতে চা গবেষণাকেন্দ্রকে উৎসাহিত করা হবে। চা নীতি ঘোষণা হবে। কিন্তু কিছুই নেই।" প্রবীণ চা শ্রমিক নেতা মণি ডার্নাল অভিযোগ করেন, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার যেদিন থেকে এসেছে চা শিল্পের দফারফা হয়েছে। ওরা চা পর্ষদকে দুর্বল করে রেখেছে। অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিতে ধারাবাহিকভাবে এতো বড় বিপর্যয় চলছে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্মল টি গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, "কেন্দ্রীয় বাজেট ঘিরে অনেক আশা ছিল। কিন্তু চা শিল্পের জন্য কিছুই নেই। আমরা হতাশ। ভয়ঙ্কর এক সংকটের মুখে চা শিল্প দাঁড়িয়ে। ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ফ্ল্যাশ মার খেয়েছে। অতিবর্ষণের জন্য বর্ষাকালীন উৎপাদন উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে। এই শিল্প টিকবে কিনা সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।" তিনি জানান, দেশের মোট উৎপাদিত চায়ের ৩৪ শতাংশ উত্তরবঙ্গে উৎপাদন হয়। রাজ্যে বছরে চারশো মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়ে থাকে। তার ৬২ শতাংশ ছোট চা বাগানের পাতা থেকে হয়। ছোট চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। দীর্ঘদিন থেকে ছোট চা বাগানকে কৃষির মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। এবারও বাজেটে সেই বিষয়ে উচ্চবাচ্য নেই।