অর্ণব আইচ: গোপাল দলপতিকে পরীক্ষা করতে গিয়ে ওয়েবসাইটের ‘ভুয়ো’ তালিকায় নিজের নাম তুলেছিলেন কুন্তল ঘোষ। গোপালকে রীতিমতো পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে নিজেই টেট পরীক্ষায় ‘পাশ’ করেন কুন্তল। ওয়েবসাইটে নাম তুলে কুন্তলের সঙ্গে ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় ‘পাশ’ করেছিল তাঁর পুরো পরিবার। এমনকী, নিজের ও আরও আটজন পরিবারের সদস্য ও বন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির জন্য গোপালকে পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের কাছে এই দাবি করেছেন কুন্তল ঘোষ নিজেই। যদিও ওই তালিকা পরে মুছে দেওয়া হয়। ফলে তালিকাটি ভুয়ো বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। ইডি’র কাছে কুন্তলের দাবি, মোট ৬৫১ জন এসএসসি ও টেট চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৩৪ কোটি টাকা তোলা হয়। তার মধ্যে ১৬ কোটি টাকা তিনি গোপাল দলপতিকে দিয়েছেন বলে দাবি কুন্তলের।
ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, মানিক ভট্টাচার্য ঘনিষ্ঠ তাপস মণ্ডল টেট ২০১৪ সালের ৯৯ জন অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর নামের তালিকা কুন্তলকে দিয়ে বলেন, আদালতে মামলা করে তাঁদের পাশ করাতে হবে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তাপস কুন্তলের সঙ্গে গোপাল দলপতির পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তীকালে এই গোপাল দলপতিই ভোল পাল্টে আরমান গঙ্গোপাধ্যায় হন। দাবি, গোপালের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ ওএসডি প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যর সঙ্গে। গোপাল সল্টলেকের বিকাশ ভবনে কুন্তলকে নিয়ে গিয়ে প্রবীরবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রাথমিক পর্ষদের অফিসে নিয়ে গেলেও তখন মানিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি কুন্তলকে। এরপর গোপাল ও তাপস কুন্তলের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে এসে কম্পিউটারে ফলাফলের ওয়েবসাইট খুলে বলেন, তাঁরা ওয়েবসাইট নিজেদের দখলে এনেছেন। ফলে অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদেরও ‘পাশ’ দেখানো হতে পারে সেখানে।
[আরও পড়ুন: তীব্র দাবদাহের জের, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্কুলে গরমের ছুটি এগিয়ে আনল রাজ্য!]
গোপাল সত্যি কথা বলছেন কি না, তার পরীক্ষা নিতে কুন্তল নিজের, তাঁর বোন, ভগ্নিপতি, দুই শ্যালিকা, শ্যালক, দুই বন্ধুর নামে অ্যাডমিট কার্ড বের করে গোপালকে দেন। দিন তিনেক পর ওই ন’জনকেই ‘পাস’ বলে দেখানো হয়। গোপাল জানান, এক মাসের মধ্যেই শিক্ষকের চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। তাই কুন্তল নিজেরটা-সহ মোট ন’জনের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা করে ৪৫ লাখ টাকা গোপালকে দেন। কিন্তু কুন্তলের দাবি, দু’মাস পরে ফের ওই ন’জনকে অকৃতকার্য বলে দেখানো হয়। কোনও নিয়োগপত্র পাননি কেউ। বিষয়টি কুন্তল তাপসকে জানালে গোপাল পালটা বলেন, তিনি বড় খেলায় ময়দানে নেমেছেন। সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের নির্দেশে ৬ নম্বর করে যাতে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতেই ৯৯ জন পাশ করবেন। এছাড়া আরও ৩০ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম গোপালকে দেন কুন্তল। ২০১৭ সালের জুনে বিকাশভবনে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বিশেষ ওএসডির অফিসে ওই প্রার্থীদের নথি ‘ভেরিফিকেশন’ হয়।
বলা হয়, কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে নিয়োগপত্র। এর জন্য কুন্তলের কাছ থেকে দেড় কোটি ও তাপস মণ্ডলের কাছ থেকে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ, মোট ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা নেন গোপাল। কিন্তু জেলার প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিলের কাছ থেকে ক্রমে অফার লেটার এলেও নিয়োগপত্র আসেনি। এদিকে, গোপাল প্রার্থীপিছু আট লাখ টাকা করে দাবি করেন। নিয়োগপত্র না পাওয়ার কারণে প্রার্থীরা টাকা দিতে না চাইলে গোপাল রীতিমতো হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত তাপস ১৩০ জন প্রার্থীপিছু আট লক্ষ টাকা করে সংগ্রহ করে গোপালকে দেন। মোট ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হলেও অফার লেটার ফিরিয়ে নেয় জেলা প্রাথমিক স্কুল কাউন্সিল। ওই টাকার মধ্যে সাড়ে সাত লাখ টাকা কুন্তল ও ২৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা কমিশন নেন তাপস। কুন্তলের দাবি, তাঁর ৩০ জন টেট প্রার্থী ছাড়াও নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের জন্য ৩৫ প্রার্থীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা করে মোট সাত কোটি টাকা নেন।
৯৮ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য আট লক্ষ টাকা করে মোট আট কোটি টাকা, ৪৬৬ জন আপার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা করে ১৬ কোটি টাকা, গ্রুপ ডি’র নিয়োগের জন্য ৫২ জন প্রার্থীর কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা করে তিন কোটি টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে গোপালকে দেওয়া ১৬ কোটি বাদেও তাপসকে দশ কোটি ও বাকি টাকা নেন কুন্তল নিজে। এ ছাড়াও কুন্তলের দাবি, হাই কোর্টে মামলা করানোর নাম করে তাপস মণ্ডল ১২০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা করে মোট ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা তোলেন বলে জানিয়েছে ইডি।