বিপ্লবচন্দ্র দত্ত ও মনিরুল ইসলাম: সুদূর উত্তরাখণ্ডের (Uttarakhand) দুর্গম পাহাড়ে নেমেছে কালান্তক তুষারধস। আর তার শীতল অভিঘাত কাঁপিয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার এক জনপদকে। উত্তরাখণ্ডে ট্রেকিংয়ে যাওয়া এলাকার তিন তরতাজা ছেলেই যে আর নেই। উদ্ধারকারী দলের তরফে পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনকে জানানোর পর খবর এল, তাঁরা আর কেউ ফিরবেন না। হাহাকারই এখন সম্বল পরিজনদের। বাগনানের মুরালিবাড় ও নদিয়ার রানাঘাটের পায়রাডাঙার মানুষ শোকস্তব্ধ। তবে উত্তরাখণ্ড সরকার শুক্রবার রাত পর্যন্ত সরকারিভাবে মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেনি।
পায়রাডাঙার বাসিন্দা ২৭ বছর বয়সি প্রীতম রায় একটি ট্রেকিং দলের সদস্য হয়ে পাহাড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁর খোঁজ নেই। আর হাওড়ার বাগনানের মুরালিবাড়ের সাগর দে (২৭), সরিৎশেখর দাস (৩৫) ও চন্দ্রশেখর দাস (৩৪) কুমায়ুন রেঞ্জে সুন্দরডুঙ্গায় ট্রেকিংয়ে গিয়ে তুষারধসের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যান। উদ্ধারকারী দলের তরফে জানানো হয়েছে এঁদের সকলের দেহ মিলেছে। বাড়ির লোকের সঙ্গে তাঁদের শেষ কথা হয়েছিল। গত ১১ অক্টোবর রাতে তখন তাঁরা জানিয়েছিলেন পরের আট-ন’দিন মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবেন। আবার ফোন করবেন ২০ অক্টোবর জাইকুনিতে নেমে। কিন্তু ২০ তারিখ বিকেলেই খবর আসে, উত্তরাখণ্ডের বাগেশ্বর জেলার পাহাড় তুষারধসে বিপর্যস্ত। সেই ইস্তক তিনজনেরও কোনও খবর ছিল না। তবুও আশা ছিল হয়তো ফিরবেন আজ না হয় কাল। কিন্তু সেই আশার প্রদীপ নিভে গেল সন্ধেয়। খবর আসে আর কেউ নেই। তবুও পরিবারের লোকজন পথ চেয়ে। এদিকে, একই ট্রেকিং টিমের অন্যতম সদস্য, বেহালার সাধন বসাকের মৃতদেহ নামিয়ে আনা হচ্ছে।
[আরও পড়ুন: পাম্প না করেই টিউবওয়েল থেকে এক নাগাড়ে বেরিয়ে আসছে জল, তাজ্জব বর্ধমানবাসী]
বাগেশ্বর জেলার এসপি অমিত শ্রীবাস্তব শুক্রবার ফোনে জানান, নিখোঁজ ট্রেকারদের সন্ধানে এদিন ফৌজি হেলিকপ্টার উড়ে গিয়েও ফিরে আসে। কারণ আবহাওয়া খুবই খারাপ। পদাতিক উদ্ধারকারী দল রওনা দিলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারেনি। তবে ট্রেকারদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন পোর্টার ফিরে এসে জানিয়েছেন, তাঁরাও সরিৎ, চন্দ্রশেখরদের হদিশ পাননি। ওঁদের টিম গত ১০ অক্টোবর কলকাতা থেকে ট্রেনে রওনা দিয়েছিল। বরেলিতে নেমে গাড়িতে হলদোয়ানি হয়ে জাইকুনি। সেখান থেকে ১২ তারিখে ট্রেকিং শুরু, সঙ্গে গাইড ও চার পোর্টার। জাগুলি হয়ে ১৪ তারিখে কাঁঠালিয়ায় গিয়ে বেসক্যাম্প করেন। ওখান থেকে কানাকাটা-সহ কুমায়ুন রেঞ্জের বিভিন্ন শৃঙ্গের দিকে যাওয়ার কথা ছিল। তারই মাঝে দেবীকুণ্ডে ওই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। রাতে ওই ট্রেকারদের মৃত্যুর খবর আসে। রাতেই দেহগুলি উদ্ধার করা হয় কানাকাটা পাসের কাছে।
পেশায় গানের স্কুলের শিক্ষক, বাগনানের সরিৎ বছর দুয়েকের একটি মেয়ের বাবা। তাঁর জ্যেঠতুতো দাদা চন্দ্রশেখরের পারিবারিক ব্যবসা, তিনি বাগনান ১ নম্বর ব্লকের খালোড় গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যও বটে। আর সাগর পেশায় হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক। সাগর-সরিতের ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা থাকলেও চন্দ্রশেখর কার্যত আনকোরা। সরিতের বাবা তুষার দাস ও সাগরের বাবা সলিল দে-ও ট্রেকার। তাঁরাও বিলক্ষণ জানেন, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বিপদ ওত পেতে থাকে। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেননি, ছেলেদের এমন ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। তিন বাড়িতে কার্যত রান্না খাওয়ার পাট চুকেছে। সাগরের মা সোনালিদেবী মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। ওখানে বসেই তুষারবাবুর আক্ষেপ, “আমার পাহাড়ের নেশা ছেলের ঘাড়ে চাপল! নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।”
পাহাড়ের টানেই হোামিওপ্যাথ পড়াশোনার পাশাপাশি হাওড়ার ওই ট্রেকিং সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন রানাঘাটের পায়রাডাঙার পূর্ব গোপালপুরের প্রীতম রায়। এবার রওনা দেওয়ার পর শেষবার মা-বাবার সঙ্গে কথা হয় সেই ১১ অক্টোবর, সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ। ঠিক ছিল, ছেলে এদিনই বাড়ি ফিরবে, পরিবর্তে এসেছে দুঃসংবাদ। প্রীতমের বাবা প্রমীলকান্তি রায় ও মা রীতাদেবী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত গ্রামীণ চিকিৎসক প্রমীলবাবু উত্তরপ্রদেশে কর্মরত ছিলেন। ছেলেকে ভরতি করেছেন মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে, হোমিওপ্যাথ কোর্সে। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র প্রীতমের একটি ছোট বোন রয়েছে।
প্রতিটি পরিবারেই শুধু হাহাকার।