রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ‘দ্য লেভার কাপ নেক্সট উইক ইন লন্ডন উইল বি মাই ফাইনাল এটিপি ইভেন্ট। আই উইল প্লে মোর টেনিস ইন দ্য ফিউচার, অফ কোর্স, বাট জাস্ট নট ইন গ্র্যান্ড স্ল্যামস অর অন দ্য ট্যুর।’ এই মহাবিশ্বে কিছু কিছু ব্যক্তিত্বের বিদায় ঘোষণা অতীব দুঃখ দেয়, মনকে নিক্ষেপ করে যন্ত্রণার ঘূর্ণাবর্তে। এই মহাবিশ্বে কিছু কিছু ব্যক্তিত্বের বিদায়-ঘোষণা আবার মনকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে চলে যায়। হৃদয়ের বাঁ দিকে কেমন একটা অসাড় অনুভূতি কাজ করে, দুঃখ-যন্ত্রণার পরিমাপ বোঝা যায় না তেমন। বৃহস্পতিবার রাতে রজার ফেডেরারের (Roger Federer) টেনিস থেকে বিদায় ঘোষণা নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় গোত্রীয়। ভুবনজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা টেনিসপ্রেমীরা তো বুঝতে পারছেন না, কী বলা উচিত? কী লেখা উচিত? কী করা উচিত? সার্বিক হাহাকার কাজ করছে চতুর্দিকে। আর নিছক টেনিসপ্রেমী বলাও ভুল হল। স্বয়ং টেনিস প্লেয়াররাও কি মেনে নিতে পারছেন ‘ধ্রুবতারা’-র এ হেন চকিত প্রস্থান? রাফায়েল নাদাল নিস্তব্ধ। বিলি জেন কিং নির্বাক। অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন সেরেনা উইলিয়ামস।
রজার ফেডেরার অবসর নিচ্ছেন! অবসর নিচ্ছেন টেনিস থেকে, একচল্লিশ বছর বয়সে। সেই রজার ফেডেরার, যিনি প্রকারান্তরে টেনিস খেলাটারই সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন গত দু’টো যুগ ধরে! আর মাঝে পড়ে কতিপয় ক’টা দিন, তার পর সব শেষ। আগামী সপ্তাহে লন্ডনে লেভার কাপ একবার হয়ে গেলে সব শেষ। তার পর থেকে টেনিস থাকবে। কিন্তু টেনিসের ‘পাবলো পিকাসো’ আর থাকবেন না। রজার ফেডেরার আর থাকবেন না।
ভারতীয় সময় সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় কুড়ি গ্র্যান্ড স্ল্যামের অধীশ্বরের বিদায়ী বার্তার পর যে হাহাকার পৃথিবীজু়ড়ে চলছে, তা সাদা পাতায় কালো কালিতে লিখে বোঝানো মুশকিল। নাদাল লিখেছেন, ‘রজার, তুমি আমার বন্ধু ছিলে, আবার প্রতিপক্ষও। প্রার্থনা করছিলাম, এই দিনটা যেন কখনও না আসে। কখনও যেন না দেখতে হয় কোর্ট ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ। আজ আমার বড় দুঃখের দিন, গোটা দুনিয়ার খেলাধুলো ভালবাসা মানুষের কাছেই দুঃখের দিন। আমি তোমাকে বলেছিলাম কথাটা। আর দেখো, আজ দিনটা ঠিক এসে গেল।’ বিলি জেন কিং দেখা গেল লিখেছেন, ‘রজার, তুমি হলে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন। তুমি যে সব অমর স্মৃতি আমাদের উপহার দিয়েছ, তা যুগের পর যুগ থেকে যাবে।’ আর পেত্রা কিভিতোভা টুইট করেছেন, ‘রজার, আজকের পর টেনিস আর আগের মতো থাকল না।” ফেডেরারের সময়ে মহিলাদের টেনিসে একাধিপত্য দেখিয়েছিলেন সেরেনা। তিনি লিখেছেন, “তোমাকে দেখেই টেনিস খেলতে শুরু করেছি। রজার ফেডেরার হওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
[আরও পড়ুন: আজ ইডেনে মহারণ, লেজেন্ডস লিগের লড়াইয়ে শামিল ৯০ প্রাক্তন ক্রিকেটার ]
নির্ভেজাল সত্যি। রাফায়েল নাদাল তাঁর চেয়ে যতই বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতুন না কেন, নোভাক জকোভিচ যতই স্কিল আর পাওয়ারের অনন্য মিশেলে আধুনিক টেনিসকে অন্য মার্গে তুলে নিয়ে যান না কেন, রজার রজারই (Roger Federer Retirement)। দু’টো যুগ ধরে টেনিস কোর্টকে শাসন যেমন করেছেন, হাজার দেড়েক ম্যাচ যেমন খেলেছেন, কুড়িটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম যেমন জিতেছেন, তেমনই নিঃশব্দে আরও একটা কাজ করে গিয়েছেন। টেনিসে শিল্পের স্থানকে দিন দিন আরও স্থায়ী করা। হাতে একটা র্যাকেট নিয়ে কোর্টে আপনখেয়ালে আঁকিবুকি কেটে বিভিন্ন প্রজন্মকে শিল্পের নেশায় নেশাতুর করে রাখা। তার যে আস্বাদ, তার যে টান, তাকে কোন সাহসে মাপবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যা? মেসি-রোনাল্ডোর শ্রেষ্ঠত্বের বিচার কি বিশ্বকাপ জয় দিয়ে হবে?
আর যে পারছেন না ফেডেরার, শরীর যে তাঁর আর দিচ্ছে না, আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিল। গত উইম্বলডন কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর কোর্টের সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল না। একটা হিসেব পাওয়া গেল যে, ২০২০ জানুয়ারির পর পাঁচটা ইভেন্টে নেমেছেন ফেডেরার। আর তার মধ্যে তাঁর হাঁটুতে তিন বার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। রজার এ দিন লিখেওছেন, শারীরিক যন্ত্রণার কথা। লিখেছেন যে, তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন কোর্টে ফিরে আসার। আবার কম্পিটিটিভ টেনিসে নামার। কিন্তু পারেননি। শরীরের কাছে, বয়সের কাছে নতজানু হতে হয়েছে তাঁকে। তাতে অসুবিধে নেই। সময়ের নিয়মে, বয়সের শর্তে সবাইকেই একদিন সরতে হয়।
কিন্তু প্রভাব? প্লেয়ার চলে গেলে কখনও কখনও তার প্রভাব যায় না, বরং আগামী প্রজন্মের সামনে অপেক্ষা করে অদৃশ্য চাঁদমারির মতো। মরীচিকার মতো যার পিছনে নিষ্ফলা ছোটাই যায় শুধু। ফেডেরার তাই, ফেডেরার সৃষ্ট পরম্পরা তাই। রাফায়েল নাদাল, নোভাক জকোভিচ আর তিনি, ফেডেরার মিলে যে টেনিস যুগ বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন, তা কখনও কেউ দেখেনি। আর কোথাও গিয়ে টেনিসের এই ‘বিগ থ্রি’-র মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অলিভ পাতার অদৃশ্য মুকুট ফেডেরারই পরবেন। তর্কাতীত ভাবে। কী করা যাবে, রজার ফেডেরার তো নিছক টেনিস প্লেয়ারের নাম নয়। রজার ফেডেরার বাসেলের এক খুদে বল বয়ের নাম, যে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। রজার ফেডেরার এক দুর্নিবার আকর্ষণের নাম, যে টেনিসের সঙ্গে আমাকে-আপনাকে প্রেম করতে শিখিয়েছিল!