‘উইকিলিক্স’-এর স্রষ্টা, সাংবাদিক জুলিয়েন অ্যাসাঞ্জ ঢের আগেই বলেছিলেন, ‘আমাদের মুক্তির সবচেয়ে বড় মাধ্যম ইন্টারনেট আমাদের বিপজ্জনক একনায়ক ব্যবস্থার দিকে চালিত করছে।’ একদশক আগে করা অ্যাসাঞ্জের সেই সতর্কতা এখন পেগাসাস কাণ্ডের মধ্য দিয়ে সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। ইন্টারনেট আমাদের এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে চালিত করছে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ তার নিজস্ব পরিসর হারাতে চলেছে। গোপনীয়তা, নিজস্বতা- এগুলির আর কোনও অস্তিত্বই আগামী দিনে থাকবে না। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
ইন্টারনেট আবিষ্কারে দুনিয়া কতটা বদলাল, তার হাতেগরম একটি দৃষ্টান্ত হালের পেগাসাস কাণ্ড (Pegasus row)। ব্যক্তিগত পরিসরে যন্ত্রের এমন অনুপ্রবেশ ইন্টারনেট ছাড়া সম্ভব হত কীভাবে? ফোনে আড়ি পাতা সেকেলে। রাষ্ট্র প্রতিদিনই গুচ্ছ গুচ্ছ নাগরিকের ফোনে আড়ি পেতে চলেছে। টেলিফোন যেদিন আবিষ্কার হয়েছে, সেদিন থেকেই বলা যেতে পারে আড়ি পাতার সূত্রপাত। পেগাসাসে প্রমাণ মিলল, ফোন আর শুধু আড়ি পাতার যন্ত্রে সীমাবদ্ধ নেই। ফোন নিজেই এখন ব্যক্তিমানুষের উপর গোয়েন্দাগিরির হাতিয়ার। আপনি হাতে বা পকেটে করে যে যন্ত্রটি নিয়ে ঘুরছেন, আসলে সে একটি গোয়েন্দা বা চর। যে আপনার উপর প্রতি মুহূর্তে নজর রাখছে। রাষ্ট্র তাকে লাগিয়ে রেখেছে আপনার সম্পর্কে সব তথ্য সরবরাহ করার জন্য। আপনার মোবাইল ফোনটি রাষ্ট্র দ্বারা আপনার উপর নিযুক্ত একটি চর বা স্পাইয়ে পরিণত হয়েছে ইন্টারনেটের দৌলতেই।
ইন্টারনেটের মাধ্যমেই পেগাসাস স্পাইওয়্যার রাষ্ট্র আপনার ফোনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর ইন্টারনেটের মাধ্যমেই আপনি প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রের নজরদারিতে। আপনি কার সঙ্গে কী কথা বলছেন শুধুই নয়, আপনার প্রতিটি মেসেজ, লোকেশন, কনট্যাক্ট-সহ ফোনের যাবতীয় তথ্য চলে যাচ্ছে রাষ্ট্রের কবজায়। শুধু আড়ি পাতা বা ফোন ট্যাপিংয়ের যুগে রাষ্ট্রের নজরে আপনি এভাবে ছিলেন না। এভাবে রাষ্ট্র অতীতে কখনও আপনার একেবারে অন্তরঙ্গ পরিসরে প্রবেশও করতে পারেনি। পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে আপনার সম্পূর্ণ অজান্তে আপনার ফোন রাষ্ট্রীয় কোনও এজেন্সি হ্যাক করে নিচ্ছে। আপনার ফোনের সব তথ্য নিজের হেফাজতে নিয়ে নিচ্ছে। ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ফোন হ্যাক করা মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু পেগাসাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে সেই কাজই হয়েছে ও হয়ে চলেছে বলে অভিযোগ।
[আরও পড়ুন: ‘এটা ওদের লড়াই’, তালিবানি আগ্রাসনের মুখে ‘বন্ধু’ আফগানিস্তানের হাত ছাড়ল America!]
টেলিগ্রাফ আইনের ৫ (২) ধারায় যে-নজরদারি রাষ্ট্র আপনার ফোনে চালাতে পারে, এক্ষেত্রে সেটাকেও অমান্য করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে এডিটরস গিল্ড থেকে শুরু করে যেসব সাংবাদিক, সমাজকর্মী মামলা করেছেন, তাঁদের অভিযোগ সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ নম্বর ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকার পেগাসাস কাণ্ডে হরণ করা হয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। পেগাসাস-অভিঘাত আরও গভীরে।
প্রায় একদশক আগে এক্ষেত্রেও সতর্ক করেছিলেন ‘উইকিলিক্স’-এর স্রষ্টা, সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এক বহুজাতিক স্বৈরতন্ত্রের দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছি। দেশের নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে গিয়ে এই অগ্রগতিকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। আমাদের মুক্তির সবচেয়ে বড় মাধ্যম ইন্টারনেট আমাদের এই বিপজ্জনক একনায়ক ব্যবস্থার দিকে চালিত করছে।’ (‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত) একদশক আগে করা অ্যাসাঞ্জের সেই সতর্কতা এখন পেগাসাস কাণ্ডের মধ্য দিয়ে সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে। পেগাসাস কাণ্ডে ওঠা অভিযোগগুলি যদি সত্যি হয়, তাহলে ইন্টারনেট আমাদের এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে চালিত করছে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ তার নিজস্ব পরিসর হারাতে চলেছে। গোপনীয়তা, নিজস্বতা- এগুলির আর কোনও অস্তিত্বই আগামী দিনে থাকবে না। সবকিছুই রাষ্ট্রের নজরদারিতে চলে আসবে। যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। অনিবার্যভাবে এই পরিস্থিতি এক একনায়কতন্ত্রের দিকে আমাদের ঠেলে দেবে।
রাষ্ট্র যদি ব্যক্তিগত ও সমাজ-জীবনের প্রতিটি স্তরে নাক গলাতে থাকে, তাহলে তো গণতন্ত্র সত্যিই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। পেগাসাস আমাদের সেই বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। পেগাসাস কাণ্ডে যে-তথ্য এখনও পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্য হলে, সেটা গুরুতর বিষয় বলে মন্তব্য করেছে দেশের শীর্ষ আদালত। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে এখনও পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, দেশের ৩০০টি ফোন নম্বর পেগাসাসের নজরদারিতে। এই ফোন নম্বরগুলির মধ্যে কারা রয়েছেন? দেশের কিছু সাংবাদিক, কিছু রাজনৈতিক নেতা, সিবিআইয়ের প্রাক্তন প্রধান, ‘র’-এর প্রাক্তন প্রধান, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির কয়েকজন ঘনিষ্ঠ, সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন কর্মী ইত্যাদি। অর্থাৎ, পেগাসাসের মাধ্যমে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলিকে। নজরদারি থেকে বাদ যায়নি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও সংবাদমাধ্যম। অর্থাৎ পেগাসাস কাণ্ডের অভিযোগ সত্য হলে, বিদ্ধ হয়েছে আমাদের গণতন্ত্র। ক্ষমতায় ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকার জন্যই এই হাতিয়ার, এই চরবৃত্তি। চতুর্দিক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এই চরবৃত্তি, যাতে কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করে কোনও স্বর। পরোক্ষে বলতে পারি, ইন্টারনেট একেবারে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে গণতন্ত্রকে।
ইন্টারনেট আবিষ্কারকে চাকা আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। চাকার আবিষ্কারে বদলে গিয়েছিল দুনিয়া। ইন্টারনেট আবিষ্কারও কি সেইভাবে বদলে দিল দুনিয়াকে? আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারিক জীবনে ইন্টারনেটের আনা বদলকে বাদ রাখলাম। দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্ম থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কাজের মুখ বদলে গিয়েছে ইন্টারনেটের দৌলতে। সোশ্যাল মিডিয়া ইমোশনাল জীবনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ইন্টারনেটের প্রভাব এবার পরিমাপ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
ইন্টারনেট যদি প্রতিটি ব্যক্তিকে এইভাবে রাষ্ট্রের নজরদারিতে এনে গণতন্ত্রের পরিসরকে সংকুচিত করে তোলে, তাহলে কি আমরা বলতে পারি না যে, ৩০০ বছরের গণতন্ত্রের ধারণা বিপন্ন? যে-কথাটা বলেছেন অ্যাসাঞ্জ। ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে মানুষের গোপনীয়তা, ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ-জীবন বিঘ্নিত হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নে বিতর্ক চলছে। এবার দেখার, রাষ্ট্র ইন্টারনেটকে হাতিয়ার করে ব্যক্তিজীবনকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় কতটা নামতে পারছে। ফলে পেগাসাস কাণ্ডে উঠে আসা অভিযোগগুলিকে কোনওভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতিমধ্যেই পেগাসাস কাণ্ডে উঠে আসা অভিযোগগুলি তদন্ত করে দেখার জন্য বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছে। দেশের আর কোনও রাজ্য এখনও সেই কাজ করেনি। কিন্তু পেগাসাস কাণ্ডে ওঠা অভিযোগগুলি নিয়ে এক অদ্ভুত এড়িয়ে যাওয়ার খেলায় নেমেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পেগাসাস কাণ্ডে সত্যতা তারা স্বীকার করছে না। আবার এটাও জোর গলায় কেন্দ্র বলছে না যে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার তারা ব্যবহার করেনি। সর্বশেষ সংসদে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে একলাইনের একটি লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পেগাসাসের নির্মাতা সংস্থা এনএসও-র (NSO Group)সঙ্গে তাদের কোনও লেনদেন হয়নি। কিন্তু, এতেও সবকিছু খোলসা হয় না। সংসদে এ নিয়ে কেন্দ্রের খোলামনে আলোচনা করা উচিত ছিল। ইন্টারনেট আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হোক। কিন্তু যদি তার কোনও অভিশাপের দিক থেকে থাকে তাহলে শুরু থেকেই আমরা যেন সতর্ক হই।