হংকংয়ের গণতন্ত্র সুগঠিত ও সুরক্ষিত। এই কথা যখন চিনের সর্বাধিনায়ক শি জিনপিং বলছেন, তখন চিনের মূল ভূখণ্ড কার্যত জেলখানা! কে কোথায় কী করছে, কার বাড়িতে কেন বেশি জল ও বিদ্যুৎ খরচ হয়, কে প্রতিবাদী, কারা সংঘবদ্ধ হতে তাল ঠুকছে, কারা প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে তৎপর- চিন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব নখদর্পণে আনতে তৎপর। এসব কি গণতন্ত্রের লক্ষণ? লিখেছেন সুমন ভট্টাচার্য
জুনের শেষে, মানে গত সপ্তাহে, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হংকং সফরে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ করোনা-ঝাপটার পরে এই প্রথম কমিউনিস্ট চিনের সর্বক্ষমতাশালী একনায়ক দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও গেলেন।
শি জিনপিংয়ের হংকং যাওয়ার কারণ ছিল একদা ব্রিটিশ শাসিত এই উপনিবেশের চিনের হাতে ফিরে আসার ২৫ বছর পূর্তি। অথচ গত কয়েক বছর ধরেই হংকংয়ে চিনা-শাসনের বিরুদ্ধে আরও গণতন্ত্র চেয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন জোরাল হয়েছে। ‘ওয়ান কান্ট্রি, টু সিস্টেম’ বা ‘এক দেশ, দুই শাসন’-এর যে প্রতিশ্রুতি একসময় দেং জিয়াও পিং দিয়েছিলেন, তার কতটা পূরণ হল, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
[আরও পড়ুন: কাশ্মীরি পণ্ডিতরা কি এখন বিজেপির ‘শাঁখের করাত’ শাঁখের করাত?]
এবার চিনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময়ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন হংকংয়ের পরিস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বরিস জনসন এবং অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সরাসরি অভিযোগ ছিল, হংকংয়ের মতো একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রে যে-ধরনের গণতন্ত্র বা প্রশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বেজিং দিয়েছিল, কার্যত তার কিছুই রক্ষিত হয়নি। বরং মূল ভূখণ্ডে লৌহ যবনিকার আড়ালে মানুষের অধিকার কিংবা বাক্স্বাধীনতা যেমন গুমরে মরে, তেমন চিত্রনাট্য হংকংয়েও অনুসৃত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, পশ্চিমের দেশগুলির গণতন্ত্র নিয়ে অভিযোগ, মানুষের বাক্স্বাধীনতার দাবিতে বেজিংয়ের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা- সবই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন চিনের সর্বাধিনায়ক। হংকংয়ে দাঁড়িয়ে শি জিনপিং বলেছেন, ছাই হয়ে যাওয়া একটা শহরকে কমিউনিস্ট চিন-ই আবার পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত করেছে। বেজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে থেকেই হংকংবাসী বুঝতে পেরেছে, আসলে গণতন্ত্রের চেহারাটা কীরকম!
শি জিনপিং হংকংয়ে দাঁড়িয়ে যখন গণতন্ত্রের এমন পাঠ দিচ্ছিলেন, তখন একটু অন্য গল্পগুলোয় চোখ বোলানো যেতে পারে। গত বছরের শেষ দিকে হংকং আসতে চেয়েছিলেন দক্ষিণ চিনের এক মহিলা। কিন্তু চিনা প্রশাসন সেই অনুমতি দেয়নি। কারণ কমিউনিস্ট প্রশাসনের মনে হয়েছিল যে, ওই মহিলা ভুয়া বিয়ের সার্টিফিকেট দাখিল করে হংকং যেতে চাইছেন, সেখান থেকে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য! কেন চিনা প্রশাসনের এরকম সন্দেহ হল? কারণ এখন চিনে বিভিন্ন ধরনের নজরদারি ক্যামেরার মাধ্যমে কে-কোথায় কী করছে থেকে কোন ব্যক্তি কীভাবে খরচ করছে- তার যে পরিসংখ্যান রাখা হয়, তা বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, ওই মহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে একসঙ্গে উইক এন্ড কাটান না! এমনকী, চিনারা যে বসন্তোৎসব একসঙ্গে যাপন করে, সেই উৎসবের সময়ও স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে দেখা যায়নি! অতএব ভদ্রমহিলা সন্দেহের তালিকায়; তাই তাঁকে আর হংকং যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি!
এটা যদি প্রথম হয়, তাহলে বিভিন্ন চিন বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রগুলি দ্বিতীয় যে উদাহরণটিকে সামনে এনেছে, তা-ও চমকে দেওয়ার মতো! ঝাও ইউকিয়াও গত কুড়ি বছর ধরে লড়ছেন মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাঁর অভিভাবকদের উপর, মানে বাবা-মা’র উপর, তৎকালীন চিনের সরকার যে অত্যাচার করেছিল, তার ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ আদায়ের জন্য। এই কারণেই তিনি গত ১০ বছর ধরে নিয়মিত বেজিং যাতায়াত করেন। কিন্তু ২০১৭-র পর থেকে যতবার তিনি নিজের শহর থেকে রাজধানী যাওয়ার জন্য টিকিট কেটেছেন, তিনি লক্ষ করে দেখেছেন যে বেজিং আসার আগেই পুলিশ তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যায়। কারণ, বর্তমান সরকারও চায় না সেই অন্ধকার অতীত নিয়ে বেশি হইচই হোক। ৭৪ বছরের ঝাও বুদ্ধিমান লোক, বিভিন্ন ধরনের সিনেমা দেখেন। তার একটা বড় অংশই গুপ্তচরদের নিয়ে রহস্য কাহিনি গোছের। বৃদ্ধ তাই বুঝে যান, বেজিং তাঁর উপর নজরদারি রাখছে এবং নিজের কার্ড ব্যবহার করে টিকিট কাটলেই ট্রেনে করে আর তাঁর রাজধানী পৌঁছনো হবে না। অতএব, ঝাও কার্ড ব্যবহার না করে, মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে, বেজিং যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাঁর অভিজ্ঞতা যে কোনও প্রতিবাদীর ডিফেন্সকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। তিনি ফোন বন্ধ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বাড়িতে পুলিশ এসে গিয়ে শুধিয়েছে, আবার ঝাও কেন বেজিং যাওয়ার কথা ভাবছেন?
এই না হলে কমিউনিস্ট চিনের শি জিনপিংয়ের প্রশাসনের গণতন্ত্র! ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর মতো বিশ্বখ্যাত পশ্চিমি সংবাদপত্রগুলি বলছে এবং তথ্যপ্রমাণ দিয়েই বলছে, হালের চিন এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, প্রতিটি নাগরিকের সব ব্যক্তিগত তথ্য তাদের কাছে সংরক্ষিত। অ্যালগরিদম আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-কে ব্যবহার করে এই নাগরিকদের মধ্যে কার কী প্রবণতা, কে বিপজ্জনক, কে প্রতিবাদ করতে পারে, কার ওই মহিলার মতো এই একনায়কতন্ত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে- সবকিছু রাষ্ট্রের নখদর্পণে রয়েছে। এই বিষয়ে সবচেয়ে আলোচিত দু’টি চিনা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার নাম: মেকভিল এবং হিকভিশন। ২০১৭ সালেই এই দু’টি সংস্থা তাদের ঘোষণাপত্রে বলে দিয়েছিল, সার্ভেইল্যান্স বা নজরদারি ক্যামেরার মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ ছবি এবং তথ্য সরকারের হাতে আসছে, বেজিং চাইলে তাদের, মানে মেকভিল বা হিকভিশনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে, যে কোনও ধরনের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বা অপরাধের চেষ্টাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। ২০১৮ সালে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রে লেখা হয়, সাংহাই-তে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যে, কারও বাড়িতে অতিরিক্ত জল বা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রবণতা থাকলে তা-ও ধরে ফেলা যাবে!
চিনের সর্বাধিনায়ক, যিনি সম্ভবত এই ২০২২-এর শেষের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আরও ক্ষমতার অধিকারী হতে চলেছেন, তিনি হংকংয়ে দাঁড়িয়ে আরও একটি কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন। বেজিং এই প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশকে শৃঙ্খলার মধ্যেও এনেছে! সত্যিই তো, গত ৩০ বছর ধরে চিনের মূল ভূখণ্ডে শৃঙ্খলা এবং গণতন্ত্রের যে-পাঠ পড়ানো হয়েছে, তাকে হংকং অবধি নিয়ে আসা হবে না?
‘৩০ বছর’ বললাম এই কারণে যে, গত শতকের নয়ের দশকে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করা ছাত্রদের জন্য তিয়েনানমেন স্কোয়্যারে ট্যাঙ্ক পাঠানো হয়েছিল। তারপর থেকে বাক্স্বাধীনতা কিংবা গণতন্ত্র চিনে কার্যত দু’টি নিষিদ্ধ শব্দ, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতোই! ২৫ বছর আগে হংকংয়ের হাতবদলের পর সেই শহরও একই ধরনের প্রশাসন দেখেছে। এবারও যখন শি জিনপিং হাতবদলের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে এসেছেন, তখন বেছে বেছে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দশজনের মধ্যে জায়গা হয়নি এমনকী ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর হংকং প্রতিনিধির। আর চিনা প্রেসিডেন্টের হংকংয়ের অনুষ্ঠানে কারও ছাতা নিয়ে ঢোকা বারণ ছিল। আসলে, হংকংয়ে ‘লিগ অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ বলে যাঁরা গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করেন, তাঁদের এতদিন বিক্ষোভ দেখানোর প্রতীক ছিল ছাতা। ‘আমব্রেলা’ যে অনেক সমস্যার মূলে সেটা হংকংয়ের চিনা শাসকরা জানে!
মাও সে তুং বা দেং জিয়াও পিংয়ের পরেই যাঁকে চিনের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং ‘আইকনিক’ নেতা বলে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা শুরু হয়ে গিয়েছে, সেই শি জিনপিং তাহলে ঠিক কোন ধরনের গণতন্ত্র বা কেমন ধরনের প্রশাসনের উদাহরণ দিতে চান? ২০১৯ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট নিজে একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন, চিনে তথ্যপ্রযুক্তি এবং যান্ত্রিক উৎকর্ষ যে জায়গায় পৌঁছেছে, যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগৃহীত হচ্ছে, তা ব্যবহার করা হবে ‘জন নিরাপত্তা’-য়। ‘গ্লোবাল টাইমস’ বা চিন সরকারের অন্য মুখপত্রগুলি সাম্প্রতিক কালে যে-দু’টি শব্দের উপর জোর দেয়, তা হল সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। এমন নিয়ন্ত্রণ যা বেজিংকে কোনওরকমভাবে বিব্রত করবে না, বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সামনে ফেলে দেবে না। তাই উইঘুরের মুসলিমদের উপর নজরদারির বন্দোবস্ত আছে, যে বৃদ্ধ কোনও ধরনের প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে বারবার প্রশাসনের কাছে চিঠি লেখেন, তাঁকে রাজধানী থেকে দূরে রাখতে ব্যবস্থা আছে। কোনও ধরনের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের অতীত আছে, এমন তিন-চারজনকে যদি একই হোটেলে দেখা যায়, তাহলেও সেই হোটেলের সামনে অতি দ্রুত পুলিশ পৌঁছে যাবে। হংকংয়ে যখন শি জিনপিং গণতন্ত্র এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ নগর জীবনের উদাহরণ দিচ্ছিলেন, তখন সেই শহরে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করা একজন চমৎকার লিখেছেন: ‘আমার বাড়ির সামনে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। জানি না আমি গৃহবন্দি, না আমাকেও মূল ভূখণ্ডের মতো কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে!’
এটাই একনায়কতন্ত্রের চেহারা। এটাই বর্তমান চিনের সর্বগ্রাসী নজরদারি ব্যবস্থার সুবিধা। প্রযুক্তি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে যে দেশে কার্যত এক বিশাল জেলখানা বানানো হয়েছে, যেখানে নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতা তো অনেক দূরের বিষয়, ন্যূনতম সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করারও উপায় নেই! ‘আই নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার’ নয়, হলিউড এই সিনেমা বানালে নাম দিতে পারে, ‘আই নো হোয়াট ইউ ডু এভরিটাইম’!